আমাদের সমাজের কাঠামোটাই এমন যে, নারী তার জীবনের মধ্যবয়সে এসে নিজের গুরুত্বকে উপেক্ষা করেন। নারীরা মাঝবয়সের স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদন, আর্থিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থান সবকিছুকে যেন অবমূল্যায়ন করেন। এই ধারণা থেকে বের হয়ে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য নারীদের সচেতন করতে প্রতিষ্ঠিত হয় মিডলাইফ ক্লাব। এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নারীর মধ্যবয়সকে মূল্যায়ন করার তাগিদ দেন বিজ্ঞজনরা।
তারা বলেন, এই বয়সে অনেকে ছেলেমেয়ের সংসারে আবার কর্মযজ্ঞ শুরু করেন। নাতি-নাতনিকে মানুষ করা, ছেলেমেয়ের সংসার সামলানো আর ঘরবাড়ি দেখে রাখা তাদের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় তাদের মানসিক সমস্যা আর বার্ধক্যজনিত নানা রোগ বাসা বাঁধে শরীরে। ন্যূনতম সচেতনতা ও যত্নের অভাবে ভুগতে হয় আমৃত্যু। এ বিষয়ে শহর এলাকায় কিছুটা সচেতনতা থাকলেও প্রান্তিক নারীরা পিছিয়ে আছেন অনেক। তাই এ বিষয়ে প্রচার-প্রচারণার ওপর জোর দেন তারা।
শুক্রবার রাওয়া কমপ্লেক্সে মিডলাইফ ক্লাবের সপ্তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাক ও পাক্ষিক অনন্যা সম্পাদক তাসমিমা হোসেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট চিকিত্সক ডা. হালিদা হানুম আক্তার। বিষয়বস্তুর ওপর সূচনা বক্তব্য দেন ক্লাবের উপদেষ্টা জাতীয় অধ্যাপক ডা. শাহলা খাতুন। সভাপতিত্ব করেন ক্লাবের সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সুরাইয়া রহমান। আরো বক্তব্য রাখেন মহাসচিব লে. কর্নেল (অব.) বেগম নাজনীন এবং ডা. শাহিদা খন্দকার। মেনোপজ (স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরবর্তী সময়) এবং তার পরের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিজ্ঞানবিষয়ক আলোচনা করেন অধ্যাপক জিন্নাত আরা নাজনীন।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সুরাইয়া রহমান বলেন, কর্মজীবন ও সংসারের সব দায়িত্ব শেষ করে মধ্যবয়সেই নারীর মৌলিক কাজ শুরু হয়। তাই এই সময়টাকে শুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করতে হবে। এটাই তাদের শ্রেষ্ঠ সময়। অধ্যাপক ডা. শাহলা খাতুন বলেন, ‘আমি দেশে মেনোপজ সোসাইটি শুরু করেছি অনেক কষ্ট করে। সহকর্মীরা বলতেন, এসব কী করছেন! এখন আমরা এই বিষয়গুলো জানি। আমাদের দেশে নারীর গড় আয়ু বেড়েছে। তাই অবসর নেওয়ার পরেও অনেক নারী কাজ করছেন। এতে মানসিক দিকটা ভালো থাকে। তাই এই সময়ের সমস্যাগুলো সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। এই সময় ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। তাই নিজেদের সুস্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। মেনোপজের সমস্যা ও করণীয় বিষয়ে প্রান্তিক নারীর জন্য প্রচার-প্রচারণা করতে হবে। এখন মেনোপজ, মাসিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলার অবস্থা তৈরি হচ্ছে।
তাসমিমা হোসেন বলেন, ‘সমাজে এখনো নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করা হয়। সহস্রাব্দে এই সময়ে এসে মেনোপজ কী, এর সমস্যা নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। সমাজের মধ্যবয়সের নারীর স্বাস্থ্যসমস্যা ও সচেতনতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে মেনোপজ খুবই তাত্পর্যপূর্ণ বিষয়। অনেকেই নারীর স্বাস্থ্যসেবা বলতে শুধু মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবাই বোঝেন। আমি আমার জায়গা থেকে প্রচার-প্রসারের দিকে অবশ্যই গুরুত্ব দেব। আপনাদের সহযোগিতায় নারী সাংবাদিকদের এই বিষয়ে মনোযোগী করে তুলতেও ভূমিকা রাখব।’
ডা. হালিদা হানুম আক্তার বলেন, ‘১২ শতাংশ প্রবীণের জায়গায় ২০৫০ সালে ২২ শতাংশ প্রবীণ হবেন। যত দিন যাবে তত এ সংখ্যা বাড়বে। এটা বন্ধ করা যাবে না। তাই তাদের জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। আমাদের পুরুষের চেয়ে নারীর গড় আয়ু বেশি। তাদের জন্য অ্যাডভোকেসি করতে হবে। তাদের আনন্দ নিয়ে বাঁচতে হবে। নিজেদের সাজতে হবে। ভালো খাবার খেতে হবে, প্রতিদিন ব্যায়াম করতে হবে। নিজেকে স্বাধীন রাখতে হবে। মনোবল দিয়ে শরীরিক সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সমাজে প্রবীণদের জন্য কিছু করার উদ্যোগকে উপেক্ষা করা হয়। কিন্তু তাদের সম্পদে পরিণত করতে হবে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিবৃন্দ।