শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৭ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

ভোট ‘ডাকাতের’ হানা স্বচক্ষে দেখল ইসি

আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০২২, ০০:০১

ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) অনুষ্ঠিত গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে ভোটকক্ষে ‘ডাকাতদের’ হানা স্বচক্ষে দেখল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ব্যালট ইউনিটের গোপন কক্ষে একাধিক ব্যক্তির প্রবেশ, এক জনের ভোট আরেক জন দিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা সিসি ক্যামেরায় দেখার পর ভোট বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থাপনায় এর আগে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। এটিকে নজিরবিহীন বলছেন নির্বাচনসংশ্লিষ্টরা। 

এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘ভোটগ্রহণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। একটি পক্ষ বা এক জন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ভোট প্রভাবিত করতে পারছেন। সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হচ্ছে না। ৫১ কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিতের পর আইন-কানুন পর্যালোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৯১ অনুচ্ছেদে যে দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়েছে, সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত। ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকবে।’ 

ইভিএমের গোপন কক্ষে প্রবেশকারীদের ‘ডাকাত’ উল্লেখ করে সিইসি বলেন, ‘এরাই ডাকাত। এরাই দুর্বৃত্ত। যারা আইন মানেন না, তাদেরই আমরা ডাকাত বলতে পারি, দুর্বৃত্ত বলতে পারি। আমাদের সবাইকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। নির্বাচন কমিশন এখানে বসে সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে পারবে না।’

গতকাল বুধবার সকাল থেকে গাইবান্ধা-৫ আসনে উপনির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ আসতে থাকে ইসিতে। অভিযোগ আসার পর ভোটকেন্দ্রে কী হচ্ছে, সেটি নির্বাচন কমিশনে বসেই স্বচক্ষে দেখেন সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনাররা। ইভিএমে ভোটারের পরিচয় শনাক্তের পর গোপন কক্ষে থাকা ব্যক্তিকে নৌকা মার্কায় ভোট দিতে দেখা যায়। নির্বাচন কমিশন একাধিকবার এই ব্যক্তিদের ‘ডাকাত’ উল্লেখ করে বলেছে, ডাকাত ঠেকানোই তাদের চ্যালেঞ্জ। তবে এই ডাকাত এবার ঠেকানো যায়নি, বরং ডাকাতের কবলে পড়ে ভোট বন্ধ করতে হলো ইসির।

গাইবান্ধা-৫ আসনের ১৪৫ কেন্দ্রের সবগুলোতেই ১ হাজার ২৪২টি সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছিল; ঢাকার নির্বাচন ভবনে স্থাপিত পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা হয় কেন্দ্রের পরিস্থিতি। ইভিএমের গোপন কক্ষে অবৈধভাবে একাধিক ব্যক্তির অনুপ্রবেশ, এক জনের ভোট আরেক জন দিয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন ঘটনা সরাসরি দেখার পর দুপুর ১টা পর্যন্ত কয়েক দফায় ৫১টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। আবার অনেক কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরার ইন্টারনেট সংযোগও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বলে সাংবাদিকদের জানান সিইসি। নির্বাচন ভবনে অবস্থিত সিসি ক্যামেরায় দেখা গেছে, পুলিশের উপস্থিতিতেই ডাকাত ইভিএমের গোপন কক্ষে প্রবেশ করে ভোটারকে প্রভাবিত করেছে। নির্বাচন কমিশনের ভোট বন্ধের ঘোষণার আগেই নৌকার প্রার্থী মাহমুদুল হাসান রিপন ছাড়া বাকি চার প্রার্থী—জাতীয় পার্টি-জাপার এ এইচ এম গোলাম শহীদ রনজু, কুলা প্রতীকে বিকল্পধারা বাংলাদেশের জাহাঙ্গীর আলম, আপেল প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদুজ্জামান নিশাদ ও ট্রাক প্রতীকে আরেক নির্দলীয় প্রার্থী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। নির্বাচন ভবনে দুপুরের আগে আগে সিইসি বলেন, ভোটের পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এর ঘণ্টা দুয়েক পরে তিনি ভোট বন্ধের সিদ্ধান্তের কথা জানান।

ইসির ফাঁদে ভোট ডাকাতরা : উল্যাসোনাতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দেখা গেছে ইভিএমের গোপনকক্ষে একজন ভোট দিচ্ছেন, আরেকজন পর্দা উচিয়ে তা পর্যবেক্ষণ করছেন। আর ভোটকক্ষের মূল গেটে দাঁড়িয়ে আছেন একজন পুলিশ সদস্য। একই অবস্থা কাতলামারীর ঝানঝাইড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। ঐ কেন্দ্রের দরজায় পুলিশ পাহারারত অবস্থায় বহিরাগতদের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবেশ দেখতে পান নির্বাচন কমিশনাররা। সাঘাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রেটি পুরোটাই ফাঁকা। কক্ষের সামনে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েক জন ব্যক্তি। আর গোপনকক্ষে দুই পুরুষ প্রবেশ করে ভোটারকে প্রভাবিত করছিলেন।  

বর্তমান কমিশনের অধীনে প্রথম ভোট হয় গত ১৫ জুন। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনসহ শতাধিক ইউনিয়ন পরিষদের ভোটে বেশ কিছু এলাকায় নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছিল। তবে ভোট চলার দিন নির্বাচন স্থগিত করার ঘটনা এই প্রথম ঘটল। জাতীয় নির্বাচনে আগে এই প্রথম কোনো সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ভোট করে হোঁচট খেলো ইসি। এজন্য সবার প্রশ্ন ছিল এক আসনে এই দশা, ৩০০ আসনে কী হবে :এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘এটা সময় বলে দেবে। একটি আসনে ঠিক হয় নাই, ৩০০ আসনে ঠিক হবে না—এটা বলা সমীচীন হবে না।  ভবিষ্যতেরটা ভবিষ্যতে দেখা যাবে।’

ভোটচুরি স্বচক্ষে দেখেছি—সিইসি: প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, গাইবান্ধায়-৫ আসনের উপ-নির্বাচনে ভোটকক্ষে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ভোট কারচুপি স্বচক্ষে দেখেছি। তাই পুরো ভোটগ্রহণ বন্ধ করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছি—ভোট গ্রহণে অনিয়ম হচ্ছে এবং অনেক কক্ষে অবৈধ অনুপ্রবেশ লক্ষ্য করেছি। অবৈধভাবে প্রবেশ করে ভোটারকে ভোট প্রদানে সহায়তা বা বাধ্য করছে—এটা সুস্পষ্ট লক্ষ্য করেছি। যেটি নিয়ম নয়। তার পরেও আমরা দেখেছি—পোলিং এজেন্ট সম্ভবত তাদের অনেকের গায়ে যে পোশাক সেখানে প্রতীক ছাপানো ছিল। মেয়েদের একই রকমের শাড়ি, ওড়না ছিল যেটা নির্বাচন আচরণবিধির পরিপন্থি। তিনি বলেন, আমাদের সহকর্মীরা সকাল ৮টা থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে দেখেছি; কেউ কক্ষ ত্যাগ করেননি। এটা প্রত্যক্ষ করেছেন এবং অনিয়মগুলো বা ম্যাল প্র্যাকটিসেসগুলো মোটা দাগে হচ্ছিল। যার ফলে আমরা উপস্থিত থেকে প্রথমে তিনটি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ বন্ধ করে দিয়েছি। এরপরে ১৬টি কেন্দ্রে, তৃতীয় দফায় ১২টি; চতুর্থ দফায় ৯টি এবং সব শেষ আরো তিনটি; মোট ৪৩টি ভোট কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করে দিয়ে সাড়ে ১২টায় কক্ষ ত্যাগ করি।

ভোট বন্ধের কারণ জানাল ইসি :ভোট বন্ধের কারণ উল্লেখ করে সিইসি আরো বলেন, আমরা লক্ষ্য করলাম—কতগুলো কেন্দ্রে সিসিটিভি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলো। যার ফলে আমরা তথ্য সংগ্রহ করতে পারছিলাম না। সবমিলিয়ে মোট ৫০টি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করেছি। রিটার্নিং অফিসারও একটি কেন্দ্রের ভোট কেন্দ্র বন্ধ করেন। এরপর আমরা কমিশনের সব সদস্য মিলে বিষয়টি পর্যালোচনা করতে থাকি, বিশ্লেষণ করতে থাকি। এ পর্যায়ে আমাদের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৯১ই ধারা অনুযায়ী কমিশনের কাছে প্রতীয়মান হয়, ভোট সঠিকভাবে হচ্ছে না। আমরা নিশ্চিত হই—৫১টি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ হয়ে গেলে বাকি কেন্দ্রগুলোর পরিবেশ, ফলাফল—সব বিবেচনা করলেও আসলে সঠিক মূল্যায়নটা হবে না। পরিশেষে পুরো নির্বাচন গাইবান্ধা-৫ নির্বাচনি এলাকার ভোট কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছি।  পরবর্তীতে বিধিবিধান অনুযায়ী কি করতে হবে দেখব। কমিশন বসে সিদ্ধান্ত নেব।

ইভিএমের দোষ নেই :ইভিএমের কারণে এই দশা কি না-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইভিএম নয়, এখানে কতগুলো হিউম্যান এলিমেন্টস এখানে। যান্ত্রিক কিংবা মেকানিকাল সমস্যা আমরা দেখি নাই। মেশিন কাজ করছে না, তা নয়। প্রিজাইডিং অফিসার আছে, পোলিং অফিসার আছে, তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ইভিএম কোনো সমস্যার সৃষ্টি করেনি। 

যাদের কারণে ভোট বন্ধ করা হলো তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘কাদের কারণে এটা হয়েছে এখনো আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি নাই। এটা এখন বলা যাবে না। নির্বাচন কেন বন্ধ হয়েছে আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখব।

নজিরবিহীন বলছেন নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা :বিষয়টি নিয়ে ইসির সাবেক নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শাখার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, এ ধরনের ঘটনা আগে ঘটেনি। একদিকে এটি যেমন নজিরবিহীন, অন্যদিকে এটি রেকর্ডও। চতুর্থ থেকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় পর্যন্ত কর্মরত কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ বলেন, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জের একটি আসনের ৪০টির মতো কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ করা যায়নি। তবে সে সময় পুরো ভোটগ্রহণ বন্ধ করা হয়নি।  এদিক থেকে এবারের মতো এতসংখ্যক কেন্দ্র কখনো বন্ধ ঘোষণা করতে হয়নি। এছাড়া ভোট চলাকালে পুরো সংসদীয় আসনের নির্বাচন বন্ধ করার নজির নেই।

উল্লেখ্য, এ আসনের সংসদ সদস্য ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া গত ২৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান। নিয়ম অনুযায়ী এরপর আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়। গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের উপনির্বাচনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৯৮ জন। ইভিএমের মাধ্যমে ১৪৫টি কেন্দ্রে ৯৫২টি বুথে ভোট গ্রহণ করা হচ্ছিল।

ইত্তেফাক/ইআ