শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

টিসিবির পণ্য কারসাজি: ইউপি সদস্যসহ ২ জনের নামে মামলা

আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০২২, ১১:৫৯

টিসিবির পণ্য কিনতে ইউনিয়ন পরিষদে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষায় ক্রেতারা। এ অবস্থায় ঘণ্টা দু'য়েকের মধ্যে আনুমানিক ৪০০ থেকে ৫০০ জন ক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রির পর ডিলার জানান, পণ্য শেষ হয়ে গেছে। তবে কিছুক্ষণ পর অপেক্ষমাণ ক্রেতাদের সামনেই ইউপি সদস্য ও ডিলার টিসিবির ২০০ প্যাকেট পণ্য কালোবাজারিদের হাতে বিক্রি করে দেন। পরে তাদের সহযোগিতায় গাড়ি ও রিকশায় এসব পণ্য সরিয়ে নেওয়া হয় অন্যত্র।

পরে ক্ষুব্ধ ক্রেতারা একটি রিকশা আটক করে বেশ কিছু পণ্য উদ্ধার করেন। এ নিয়ে হাতাহাতিতে আহত হয়েছেন গ্রাম পুলিশের একজন সদস্য। এমন ঘটনা ঘটেছে মৌলভীবাজারের বড়লেখার দক্ষিণভাগ দক্ষিণ ইউনিয়নে।

এ ঘটনায় উপজেলার দক্ষিণভাগ দক্ষিণ ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ইমরান আহমদ (৩৬) ও টিসিবির পণ্য ক্রয় করা ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলামের (৩৫) বিরুদ্ধে বড়লেখা থানায় মামলা হয়েছে। তাদের বাড়ি ইউনিয়নের পূর্ব হাতলিয়া গ্রামে। মামলায় ৩ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।

শনিবার (১৫ অক্টোবর) দুপুরে বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের উপ-প্রশাসনিক কর্মকর্তা বিনয় চন্দ্র দেব বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। পাশাপাশি টিসিবির ডিলার আতাউর রহমানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

বড়লেখা থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. ফরিদ উদ্দিন মুঠোফোনে মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।’

মামলা ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার দক্ষিণভাগ দক্ষিণ ইউনিয়নে টিসিবির পণ্য বিক্রির জন্য ১ হাজার ১২৭ জন উপকারভোগী নির্ধারিত রয়েছেন। গত শুক্রবার (১৪ অক্টোবর) ছুটির দিনের সুযোগে উপজেলা প্রশাসনকে না জানিয়েই টিসিবির পণ্য ইউনিয়ন পরিষদে বিতরণের জন্য নিয়ে যান ডিলার। সেখানে ইউপি চেয়ারম্যান, সদস্য ও ট্যাগ অফিসারের উপস্থিতে টিসিবির ডিলার আতাউর রহমান দুপুর থেকে পণ্য বিক্রি শুরু করেন। বিকেল সাড়ে ৩টায় লাইনে কার্ডধারী উপকারভোগীরা দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও ডিলার পণ্য শেষ হয়ে গেছে জানিয়ে তাদের ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করেন।

এরই মধ্যে ইউপি সদস্য ইমরান আহমদের উপস্থিতিতে মুদি ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম ২০০ জনের প্যাকেট একটি পিকআপভ্যান ও রিকশায় তুলে নিয়ে গেলে অপেক্ষমাণ উপকারভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা হট্টগোল শুরু করেন। এ সময় উপকারভোগীরা ১৭০ কেজি চিনি, ৩২ লিটার সয়াবিন তেল ও ৩৪ কেজি মসুর ডাল আটক করেন। এ নিয়ে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হলে হাতাহাতিতে শ্যামল বাগতি নামে গ্রাম পুলিশের এক সদস্য আহত হন। খবর পেয়ে থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

এর আগে ইউনিয়নের ১ নং প্যানেল চেয়ারম্যান আজিজুল হক গ্রাম পুলিশের সহযোগিতায় ইউপি সদস্য ইমরান আহমদের কাছে থেকে ৫০ প্যাকেট পণ্য উদ্ধার করেন। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুনজিত কুমার চন্দ পুলিশ নিয়ে ব্যবসায়ী সাইফুলের বাড়িতে অভিযান চালান। কিন্তু এর আগেই অবশিষ্ট ১৫০ প্যাকেট পণ্য সরিয়ে ফেলায় উদ্ধার করা যায়নি।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ১ হাজার ১২৭ জন উপকারভোগীর মধ্যে ঘণ্টা দু'য়েকের মধ্যে আনুমানিক ৪০০ থেকে ৫০০ ক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রি করা হয়। এর ফাঁকে কৌশলে ডিলার-ইউপি সদস্যরা কালোবাজারিদের কাছে বেশ কিছু প্যাকেট বিক্রি করেছেন। তবে একসঙ্গে পিকআপভ্যান ও রিকশা দিয়ে ২০০ প্যাকেট পাচারকালে ঘটনাটি ধরা পড়ে।

দক্ষিণভাগ দক্ষিণ ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ইমরান আহমদ তার বিরুদ্ধে ওঠা সকল অভিযোগ অস্বীকার করে মুঠোফোনে বলেন, ‘আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে। পণ্য পাচার যদি হয়েও থাকে সেটা ইউপি সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান আজিজুল হকের উপস্থিতিতে হয়েছে। ঘটনাটি আমাকে জানানোর পর আমি নিজে ৫০ প্যাকেট পণ্য উদ্ধার করে দিয়েছি।’

তবে ইউপি সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান আজিজুল হক মুঠোফোনে বলেন, ‘আমি বেলা সাড়ে ১১টায় ইউনিয়নে গিয়ে দেখি চেয়ারম্যান সাহেব বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। আড়াইটা পর্যন্ত বিতরণ কাজে সহযোগিতা করি। এর মধ্যে চেয়ারম্যান চলে যান। যাওয়ার সময় চেয়ারম্যান বলে যান, ইমরান মেম্বারের মাধ্যমে ২০০ প্যাকেট পণ্য যাবে। তবে কার জন্য যাবে এটা বলেননি। শুধু বলেছেন, ২০০ প্যাকেটের টাকা আমার কাছে দিয়ে যাবে। তখন আমি তাকে (চেয়ারম্যান) ডিলারের সাথে কথা বলতে বলি।’

‘এরপর চেয়ারম্যান ডিলারের সাথে কথা বলে যান। এরই মধ্যে অর্ধেকের মতো বিতরণ হয়েছে। তখন ব্যবসায়ী সাইফুল এসে ১২৫ জনের টাকা দিয়ে বলেন, এগুলো নেন। ৭৫ জনের টাকা পরে দিচ্ছি। তখন তাকে বলি, আমি এসব ভেজালে নাই। আপনি ডিলারের সাথে কথা বলেন। পরে আমি ইউপি সদস্য ইমরানকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বাড়িতে খাবার খেতে যাই। উনাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার ঘণ্টা দেড়েক পরে এই পণ্য পাচার হয়েছে।’

আজিজুল হক আরও বলেন, ‘এরপর ইউনিয়ন থেকে ফোন পেয়ে দ্রুত সেখানে যাই। ইউনিয়নে গিয়ে জানতে পারি, একসঙ্গে ২০০ জনের পণ্য পিকআপভ্যানে তোলা হয়। পরে জায়গা না হওয়ায় রিকশায় নেওয়া হয় কিছু। তখন গাড়ি দ্রুত চলে যায়। আর মানুষ ভ্যান আটকে রাখেন। এ নিয়ে হাতাহাতিতে গ্রাম পুলিশ আহত হন। উপস্থিত মানুষকে পণ্য বুঝিয়ে দিতে আমি গ্রাম পুলিশ সোলেমান আলী ও রিকশাচালক আব্দুল কুদ্দুসের সহায়তায় ৫০ প্যাকেট উদ্ধার করি। পরে এগুলো উপস্থিত লোকজনের কাছে বিক্রি করা হয়।’

ইউপি চেয়ারম্যান আজির উদ্দিন বলেন, ‘জরুরি কাজে বের হওয়ায় আজিজুল মেম্বারকে দায়িত্ব দিয়ে যাই। মূল দায়িত্ব ডিলারের। যার কার্ড আছে তাকে তিনি পণ্য দেবেন। ইমরান মেম্বার বললেই ডিলার পণ্য তো দেওয়ার কথা না। আর আজিজুল মেম্বার যে বলেছেন, ইমরান মেম্বারের ২০০ প্যাকেট একজনকে দেওয়ার কথা আমি বলেছি, এটা ঠিক নয়। এটা মিথ্যা কথা।’

মামলায় নেই ডিলারের নাম:

ক্রেতাদের সামনে ইউপি সদস্য ও ডিলার টিসিবির ২০০ প্যাকেট পণ্য কালোবাজারিতে বিক্রি করে দিলেও মামলায় ডিলার আতাউর রহমানকে আসামি করা হয়নি। তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

টিসিবির পণ্য বিক্রিতে সিন্ডিকেট:

বড়লেখায় টিসিবির পণ্য বিক্রির শুরু থেকে অনিয়মের অভিযোগ করছেন উপকারভোগীরা। মূলত কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও ডিলারের যোগসাজশে কালোবাজারিতে এসব পণ্য বিক্রি হতো। কিন্তু এসব তদারকির দায়িত্বে থাকা উপজেলা প্রশাসন ডিলারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুনজিত কুমার চন্দ শনিবার রাতে মুঠোফোনে বলেন, ‘কালোবাজারিতে টিসিবির পণ্য বিক্রির খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে যাই। ডিলার আমাকে না জানিয়েই বন্ধের দিন পণ্য বিক্রি করেন। প্রাথমিকভাবে কালোবাজিরতে বিক্রির প্রমাণ পাওয়ায় ইউপি সদস্য ও ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা হয়েছে। ডিলারকে শোকজ করা হয়েছে। মামলার তদন্তে জড়িত অন্য অভিযুক্তের নাম উঠে আসবে।’

ইত্তেফাক/এসকে