মঙ্গলবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ১৮ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বান্দরবানে কুকি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান, ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা

আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০২২, ০০:৪০

সম্প্রতি ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা দুর্গম পাহাড়ে বাড়িছাড়া কিছু তরুণ জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। সশস্ত্র সংগঠন ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ (কেএনএফ) তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। সংগঠনটি স্বাধীন বাংলাদেশের ভূখণ্ডের একটি অংশ বিচ্ছিন্ন করার নীলনকশাও বাস্তবায়নের অপচেষ্টা করে যাচ্ছে তারা। গ্রেফতারকৃত কুকি সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে এমন তথ্য পাওয়ার পর অভিযান শুরু করেছে যৌথ বাহিনী। নিরাপত্তার কারণে বান্দরবানের রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় গতকাল মঙ্গলবার থেকে পর্যটকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে প্রশাসন। 

র‍্যাব মহাপরিচালক খুরশিদ আলম ইত্তেফাককে বলেন, ‘স্বাধীন দেশে এই ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম কোনোভাবেই চলতে পারে না। আমরা যৌথ অভিযান শুরু করেছি। তাদের পুরোপুরি নির্মূল না করা পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত থাকবে।’ 

২০০৮ সালে তৈরি পাহাড়ি সংগঠন ‘কেএনএফ’ এরই মধ্যে নিজস্ব পতাকা বানিয়েছে। তৈরি করেছে মনগড়া মানচিত্র। এসব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আলাদা রাজ্য বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারী-পুরুষের সমন্বয়ে গড়েছে প্রশিক্ষিত নিজস্ব বাহিনী। যাদের দেওয়া হয়েছে সামরিক বাহিনীর আদলে কমান্ডো প্রশিক্ষণ। তাদের রয়েছে আলাদা ইউনিফর্ম, র‍্যাংকভিত্তিক আলাদা আলাদা ব্যাচ। ইউনিফর্মের হাতে রয়েছে তাদের নিজস্ব পতাকা। 

সম্প্রতি উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় হিজরতের নামে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া ১৯ জেলার ৫৫ তরুণের তালিকা প্রকাশ করেছে র‍্যাব। তাদের মধ্যে ৩৮ জনের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা প্রকাশ করা হয়েছে। র‍্যাব জানায়, ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’। যার বাংলা অর্থ-পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার। এই সংগঠনের আহ্বানে বাড়ি ছাড়ে তরুণরা। কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া অন্তত ৩৮ তরুণ এই কেএনএফের অধীনে দুর্গম পাহাড়ে রয়েছে বলে জানিয়েছে র‍্যাব। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর স্থান তাদের হামলার টার্গেট হতে পারে—এমন গোয়েন্দা তথ্যের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী ও র‍্যাব যৌথ অভিযান পরিচালনা করছে।

ইতিমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংঘতি সমিতির (জেএসএস) ওপর হামলা চালিয়েছে ‘কেএনএফ’। বলা হচ্ছে, এরা জেএসএসের প্রতিপক্ষ একটি দল। সম্প্রতি হামলা চালিয়ে জেএসএসের নেতাকে হত্যার পর পাহাড়ে কেএনএফকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কেএনএফের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কার্যক্রমের নিয়মিত আপডেট তারা ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল দেয়। ফেসবুকে তাদের সদস্যদের ইউনিফর্ম পরা ছবি দিলেও মুখ ঘোলা করে দেওয়া হয়। সম্প্রতি অস্ত্র হাতের কিছু ভিডিও প্রকাশ পেয়েছে। 

‘কেএনএফ’ সন্ত্রাসীদের কমান্ডো প্রশিক্ষণ
জানা গেছে, ‘কেএনএফ’-এর সশস্ত্র শাখার ক্যাডাররা ২০১৯ সালে ইনফ্যান্ট্রি কমান্ডো প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী ছয়টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাধ্যমে পার্বত্যাঞ্চলে খ্রিষ্টান বাফার রাষ্ট্র তৈরির জন্য নতুনভাবে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। গোষ্ঠীগুলো হলো—বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি। পার্বত্যাঞ্চলের ৯টি উপজেলা নিয়ে কেএনএফের অঙ্কিত মানচিত্রের সীমানায় পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত একটি পৃথক রাজ্যের দাবিতে সংগঠনটি ২০১৭ সালে সশস্ত্র শাখায় রূপ নেয়। কিন্তু প্রকাশ্যে আসে সম্প্রতি। অথচ সংগঠনটি প্রাথমিক পর্যায়ে কেএনডিও নামে একটি সেবামূলক এনজিওর খোলসে যাত্রা শুরু করে। 

সূত্র জানায়, নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া তাদের বাছাই করা তরুণদের ছোট ছোট গ্রুপে সিনিয়র সদস্যের হেফাজতে রাখে। যেসব বাড়িতে রাখা হয়, সেটাকে তারা আনসার হাউজ (সাহায্যকারীর বাড়ি) বলে। এরপর চরাঞ্চলে শারীরিক কসরতসহ প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে উত্তীর্ণদের প্রশিক্ষণের জন্য বান্দরবানে কেএনএফর ক্যাম্পে পাঠানো হয়। কেএনএফর ক্যাম্পে এই জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ শুরু হয় চলতি বছরের শুরুতে। সেখানে একে-৪৭ রাইফেল, পিস্তল ও কাটা বন্দুক চালানো, বোমা (আইইডি) তৈরি এবং চোরাগোপ্তা হামলার (অ্যাম্বুশ) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। র‍্যাব বলছে, গ্রেফতার কুমিল্লার মসজিদুল কোবার ইমাম হাবিবুল্লাহ দুই বছর ধরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে মাদ্রাসা চালাচ্ছিলেন। সেখানে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণ চলছে।

গত রবিবার ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর কার্যালয়ে অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে প্রশিক্ষণরত নতুন যে জঙ্গি সংগঠনের খোঁজ মিলেছে সেটি আর পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ ক্যাম্পের অবস্থান পাশাপাশি ছিল বলে ধারণা করছি। আমাদের সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে পুলিশ, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায়ই রয়েছে। আমাদের পুলিশ, বিজিবি, র‍্যাব প্রয়োজনে সেনাবাহিনীও সেখানে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। 

কেএনএফের প্রতিষ্ঠাতা কে এই নাথান বম 
নাম- নাথান বম। তিনি বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার এডেনপাড়ার অধিবাসী। রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামক সশস্ত্র গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান। ‘কেএনএফ’-এর হেডকোয়ার্টার বলা হয়—সাইজাম পাড়াকে। 

নাথান বম একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বান্দরবান ৩০০ নম্বর আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে ২৯ নভেম্বর জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে মনোনয়ন ফরম দাখিল করেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব হয়নি।

নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। তিনি এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। কুকি-চিনভুক্ত জাতিগোষ্ঠীর পরিচিতি নিয়ে ‘দ্য বমজৌ’ বইসহ গবেষণামূলক তার ছয়টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এ কারণে নাথান বম লেখক হিসেবে অনেকের কাছে পরিচিত। স্কুল ও কলেজ লাইফ থেকে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন করার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। সেই সংগঠন কেএনএফ। 

সংগঠনটি রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম—এই উপজেলাগুলো নিয়ে আলাদা রাজ্যের দাবি করেছে। তাদের দাবি পার্বত্য চট্টগ্রামে একসময় কুকি চিন রাজ্য ছিল।  চাকমারা তাদের সে রাজ্য দখল করে তাদের উচ্ছেদ করেছে। সে রাজ্য পুনরুদ্ধার এবং স্বাধীন কুকি চিন রাজ্যের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছে। তাদের আরো দাবি, তাদের সামরিক শাখার শতাধিক সদস্য গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে পাড়ি জমান বছর তিনেক আগে। ২০২১ সালে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি দল ফিরে আসে। চলতি বছর তারা আত্মগোপনে যায়। 

সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান : রুমা-রোয়াংছড়ি ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা
আমাদের বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, নিরাপত্তার কারণে রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় গতকাল মঙ্গলবার থেকে পর্যটকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এই দুই উপজেলার সীমান্তবর্তী পাহাড়গুলোতে নিরাপত্তা বাহিনীর সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান সফল করার লক্ষ্যে এবং পর্যটকদের নিরাপত্তার স্বার্থে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। নিষেধাজ্ঞার কারণে গতকাল বিকালের মধ্যেই দুই উপজেলা থেকে সকল পর্যটকের পাশাপাশি অনেক সাধারণ নাগরিকও ফিরে এসেছে। জেলা সদর থেকে অনেক পর্যটক ফিরে গেছে তাদের নিজ গন্তব্যে।  

নিরাপত্তা বাহিনী ও প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, সন্ত্রাসীদের ধরতে প্রচারপত্র বিলি করা হচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়। তাদের অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিলে ১ লাখ টাকা পুরস্কারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। কেএনএফের  প্রধান  নেতা নাথান বমসহ সদস্যরা এখন আত্মগোপনে। 

বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, যৌথ বাহিনীর সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান পরিচালনার কারণে নিরাপত্তার স্বার্থে রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় পর্যটকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। পর্যটকদের নিরাপত্তা বিবেচনায় অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন