শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নিম্নমানের যন্ত্রপাতি বাড়িয়েছে বিদ্যুৎ ভোগান্তি, দেখার কেউ নেই?

আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০২২, ২৩:৪৩

বিদ্যুতের গ্রিড বিপর্যয়ের পর থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশেই বেড়ে গেছে লোডশেডিং। কোথাও ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা আবার কোথাও ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং এর খবর পাওয়া যাচ্ছে। গ্রামে কোথাও কোথাও ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিংয়ের অভিযোগ এসেছে। গ্রামের মানুষের ভোগান্তি এখন চরম আকার ধারণ করেছে। সে ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে তুলেছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি এবং ডলার সংকটের কারণে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস করতে বাধ্য হয় এবং সিডিউল মেনে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং চালু করে। সরকার জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস করে লোডশেডিং এর মাধ্যমে বর্তমান সংকট মোকাবিলার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও গ্রাম অঞ্চলে লোডশেডিংয়ের তীব্রতা বৃদ্ধি এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন থাকার ভিন্ন কারণ জানা যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছে, গ্রিড বিপর্যয়ের পর আরইবির বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। এর পেছনে একটি অন্যতম কারণ হলো তাদের বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন এবং বিদ্যুৎবিতরণ লাইনগুলোতে অত্যন্ত নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদির ব্যবহার। অভিযোগ আছে, আরইবির শতভাগ বিদ্যুতায়নের নামে কোটি কোটি টাকার কেনা মালামাল এখন ব্যবহার অযোগ্য হওয়ায় তা নিলামে বিক্রি করছে।

জানা যায়, বাংলাদেশের গ্রাম অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে আরইবির তার পল্লী বিদ্যুৎসমিতির মাধ্যমে প্রতিবছর উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে বিপুল অংকের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ক্রয়করে থাকে। সাম্প্রতিককালে আরইবি উন্মুক্ত দরপত্রের নামে অত্যন্ত নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ক্রয় করে আসছে যা বৈদ্যুতিক বিতরণ লাইনে ব্যবহার করা হয়। ফলে সংস্থাটি কর্তৃক বর্তমানে সারা দেশব্যাপী নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সেবা প্রদান কঠিন হয়ে পড়েছে।

আরইবি সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় এসপিসি পোল একটি অন্যতম উপাদান। প্রতিটি গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর লক্ষ্যে বিদ্যুৎবিতরণকারী সংস্থা প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ এসপিসি পোল ক্রয় করে। এই এসপিসি পোল ক্রয়েপূর্বের দুর্নীতি আবার ফিরে এসেছে। বিএমটিএফসহ বেশ কয়েকটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান গুণগতমানসম্পন্ন এসপিসি পোল সরবরাহ করলেও সম্প্রতি আরইবির কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কোনরকম নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে নামসর্বস্ব সরবরাহকারীর কাছ থেকে নিম্নমানের এসপিসিপোল কিনছে যার ফলে বর্তমানে আরইবির মাধ্যমে গ্রাহক পর্যায়ে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহকরা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এসব নিম্নমানের এসপিসি পোল বিদ্যুৎ বিতরণ লাইনে ব্যবহার করার অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ভেঙে পড়ে এবং বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দেয়। পোল ভাঙার কারণ হিসেবে নিম্নমানের কাঁচামাল ব্যবহার, কাঁচামাল ব্যবহারের অনুপাত সঠিক না রাখা এবং প্রস্তুতকারকের কারিগরি জ্ঞানের অভাব। তাই ঝড়ো হাওয়া কিংবা যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেই পোল ভেঙে পড়ে।

এছাড়া বৈদ্যুতিক বিতরণ লাইনে শর্ট সার্কিট বা অন্য কোন সমস্যা দেখা দিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমস্যযুক্ত লাইনটিকে সাময়িকভাবে মূল লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য সাধারণত অটোমেটিক সার্কিট ক্লোজার অথবা আউটডোর ব্রেকার বসানো হয়।  

জানা যায়, দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুত করা নিম্নমানের আউটডোর ব্রেকার বসানোর ফলে প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৈদ্যুতিক লাইন বিচ্ছিন্ন না হওয়ার কারণে প্রায়ই সঞ্চালন লাইনের সমস্যা হচ্ছে বলে জানা যায়। এছাড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলো বর্তমানে অল্প দামে বাজার হতে চাইনিজ সুইচ, ব্রেকার ও রিলের মত বৈদ্যুতিক মালামাল ডিপিএম পদ্ধতিতে কিনছে। এতে করে সঠিক সময়ে ব্রোকার কিংবা অটোমেটিক সার্কিট ক্লোজার ট্রিপ করে না এবং গ্রিড ট্রিপ করে যায়। বিশেষত শিল্প কারখানাগুলোতে এ ধরনের বিদ্যুৎ বিভ্রাট এর কারণে অনেক টাকার কাঁচামাল এবং উৎপাদিত পণ্য নষ্ট হচ্ছে। 

অভিযোগ রয়েছে যে, আরইবির সাবেক ও বর্তমান কিছু শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার কাছের আত্মীয়-স্বজন এইসব নিম্নমানের বিতরণ সামগ্রী সরবরাহের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত যারা উন্মুক্ত দরপত্র অংশগ্রহণ করে এসব কর্মকর্তার মাধ্যমে নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে থাকে। এমনকি তাদের এসব বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরির কারখানা স্থাপন করার ক্ষেত্রে তারা কারিগরি সেবা দেওয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নতুন উৎপাদনকারীর কাছ থেকে বৈদ্যুতিক সামগ্রিক কেনার আগে তাদের কারখানা পরিদর্শনের বিধান থাকলেও দরপত্র অনুসারে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা ও পণ্যের গুণগত মান বিবেচনা করা হয় না। এসপিসি পোল ভূগর্ভস্থ ক্যাবল, বৈদ্যুতিক তার, বিতরণ ট্রান্সফরমার কেনার ক্ষেত্রে এমন ঘটনার নজির রয়েছে।

প্রসঙ্গত, আরইবি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও স্থানীয় মুদ্রা তহবিলের আওতায় উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে এসব মালামাল কিনে থাকে। সাধারণত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের আওতায় মালামাল ক্রয়ের সময় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ঋণ বা অনুদান দাতা) কর্তৃক প্রণীত/নির্দেশিত দরপত্র দলিল অনুযায়ী পূর্ব অভিজ্ঞতা, আর্থিক যোগ্যতা এবং কারিগরি যোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে দরপত্র মূল্যায়ন ও মালামাল ক্রয় করে থাকে। এই ক্ষেত্রে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক নির্দেশাবলী অনুসরণ করতে বাধ্য থাকে। কিন্তু স্থানীয় মুদ্রা তহবিলের আওতায় স্থানীয় দরপত্রের ক্ষেত্রে দরপত্রের শর্ত শিথিলসহ অযোগ্য দরদাতাদের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরির জন্য দরপত্রের সাজানো হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। 

এক্ষেত্রে দরপত্র আহ্বানের আগেই দরদাতা নির্দিষ্ট করা থাকে। এমনকি স্থানীয় দরপত্রের ক্ষেত্রে আরইবির কর্মকর্তারা তাদের পছন্দশীল সরবরাহকারীকে কার্যাদেশ দেওয়ার জন্য দরপত্রে তাদের সুবিধামতো বিভিন্ন শর্ত সংযোজন বা বিয়োজন করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় দরপত্রমূল্যায়ন কমিটির দরপত্রে প্রণীত টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন যথাযথভাবে অনুসরণ না করে পছন্দসই সরবরাহকারীকে কার্যাদেশ দেওয়ার জন্য শর্ত শিথিলতা অবলম্বন করে অর্থাৎ একই মালামাল ক্রয়ের জন্য বিভিন্ন দরপত্রে বিভিন্ন শর্ত আরোপ করা হয়। ফলে প্রকৃত মালামাল সরবরাহকারীরা সঠিক ও গুণগত মালামাল সরবরাহে ব্যর্থ হয়। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, সরকার বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে চাহিদার তুলনায় বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হলেও কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কারণে একদিকে যেমন সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে অন্যদিকে আরইবিকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ টাকা দিচ্ছে। সেই সঙ্গে সাধারণ জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সেবা থেকে। এছাড়া নিম্নমানের যন্ত্রপাতি কেনার ফলে সেগুলো দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে সরকারের যেমন অর্থ অপচয় হচ্ছে তেমনি সাধারণ মানুষও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। 

ইত্তেফাক/এএএম