শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

এসিড সন্ত্রাসের ভয়াবহতা নিয়ে আপিল বিভাগ

অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া না হলে বিচারের নামে তামশা হবে

আপডেট : ২৯ অক্টোবর ২০২২, ২২:০০

আয়শা সিদ্দিকা লীনা ১৮ বছরের এক তরুণী। এক যুগ আগে স্বামীর ছোড়া এসিডে ঝলসে যায় মুখমণ্ডলসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ। সেই ঝলসে যাওয়া শরীর সাক্ষ্য দিচ্ছে বর্বর, অসভ্য ও অমানবিক এক এসিড সন্ত্রাসের। ওই হামলায় শরীর ঝলসে যাওয়ায় শারীরিক ও মানসিক ক্ষত আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন ভিকটিম। এসিড সন্ত্রাসের এ ধরনের অপরাধকে ক্ষমাশীলতার দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই মর্মে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। 

আদালত বলেছেন, এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধে অভিযুক্ত অপরাধীদের অপরাধ নমনীয় দৃষ্টিতে বিবেচনা করা হলে তা হবে বিচারের নামে তামশার শামিল। সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন, বিচারপতি মুহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান, ও বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।

প্রতিকি ছবি (সংগৃহীত)

পূর্ণাঙ্গ রায়টি লিখেছেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। রায়ে আপিল বিভাগ বলেছে, সাক্ষীদের সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে এটা দেখা যাচ্ছে যে- ঘটনার রাতে ভিকটিম লীনা ও তার স্বামী আকবর আলী একসঙ্গে ঘরে অবস্থান করছিলেন। স্ত্রী এসিড সন্ত্রাসের শিকার হওয়ার পর তাকে ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি। সে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। যেখানে নিজের স্ত্রী এসিডে ঝলসে গিয়েছে,  কিভাবে এ অবস্থার শিকার হল এবং এই দুর্দশা  থেকে স্ত্রীকে রক্ষা না করে তিনি পালিয়ে গেলেন। এতেই প্রমাণিত হয় যে স্বামী তার স্ত্রীকে এসিড নিক্ষেপ করেছে। সাক্ষীদের সাক্ষ্যে অভিযোগটির সত্যতা নিরূপণ হয়েছে। তাই নিম্ন আদালত সঠিকভাবেই আসামিকে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করে কোন ধরনের ভুল করেনি।

প্রতীকী ছবি (সংগৃহীত)

২০০৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মধ্য রাতে স্ত্রী লীনার শরীরে এসিড ছুড়ে মারেন স্বামী আকবর আলী। পরদিন ভিকটিমের বাবা সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থানায় এসিড অপরাধ দমন আইনের ৫(ক) ধারায় মামলা করেন। এই মামলার চাক্ষুষ সাক্ষী ছিলেন লীনা নিজেই। তিনি তার সাক্ষ্যে বলেছেন, সৌদি আরবে তার স্বামী তাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু যেতে অস্বীকার করায় তার উপর এসিড নিক্ষেপ করা হয়। লীনার আশংকা ছিলো তার স্বামী সৌদি আরবে নিয়ে গিয়ে তাকে বিক্রি করে দেবে। 
মামলার অপর সাক্ষীরাও সাক্ষ্যে বলেছেন, ঘটনার রাতে স্বামী ও স্ত্রী একই ঘরে অবস্থান করেছেন। কিন্তু এসিড নিক্ষেপের পর ভিকটিমের স্বামীকে আর ঘটনাস্থলে খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ছবি- সংগৃহীত

এই মামলায় ২৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষে সিরাজগঞ্জের এসিড অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল আসামি আকবর আলী ওরফে জেল হক মণ্ডলকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামি। সেই আপিল খারিজ করে ফাঁসি বহাল রাখে হাইকোর্ট। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামি।

সেই আপিল শুনানিতে আসামির আইনজীবী ফরিদ আহমদ বলেন, আসামি ১২ বছর ধরে কনডেম সেলে রয়েছেন। মৃত্যুদণ্ড হ্রাস করে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হোক।

জবাবে রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাসান চৌধুরী বলেন, এই মামলার চাক্ষুষ সাক্ষী ভিকটিম নিজেই। এই এসিড সন্ত্রাসের ভয়াবহতা ভিকটমকে শারীরিক ও মানসিকভাবে আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি বহাল রাখা হোক।

সুপ্রিম কোর্ট। ছবি: সংগৃহীত

উভয় পক্ষের শুনানি, সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও মামলার নথি পর্যালোচনা করে আপিল বিভাগ রায়ে বলেছে, একজন তরুণীর উপর এসিড নিক্ষেপ শুধু অমানবিকই নয়, এটা বর্বর ও ঘৃণ্য অপরাধ। কোন সভ্য সমাজ এ ধরনের অপরাধ মেনে নিতে পারে না। এই এসিড সন্ত্রাসের শিকার নারীকে এই অপরাধের শারীরিক ও মানসিক ভয়াবহতা সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। অনেক সময় ভিকটিমের মানসিক বৈকল্য দেখা দেয়। তাই এসিড নিক্ষেপের অপরাধ শুধু ভয়ংকরই নয়, খুনের চেয়ে কোন অংশে কম অপরাধ নয়। 

রায়ে বলা হয়েছে, একজন ভিকটিম কখনোই চাইবে না যে প্রকৃত অপরাধী সাজার বাইরে থাকুক। আর এই মামলায় যিনি মূল অপরাধী তিনি ভিকটিমের স্বামী। তাকে সর্বোচ্চ শাস্তির মত অপরাধে জড়িয়ে আদালতে ভিকটিম যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তার সাক্ষ্যমূল্য অপরিসীম। এই সাক্ষ্যকে অবিশ্বাস করার কোন যুক্তিসংগত কারণ নাই। 

সুপ্রিম কোর্ট। ছবি- সংগৃহীত

আপিল বিভাগ বলেছে, এ ধরনের অপরাধীদের ছাড় দেওয়ার কোন সুযোগ নাই। যদি দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়া যায় তাহলে এসিড সন্ত্রাসের মত ঘৃণ্য অপরাধ হ্রাসে তা ভূমিকা রাখবে। তাই কোনভাবেই আসামির সাজা হ্রাসের সুযোগ নাই। মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হলো। কারণ শুধু অপরাধী নয়, আসামিরও ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

রায় প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার মেহেদী হাসান চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন, এটা যুগান্তকারী রায়। ভবিষ্যতে এ ধরনের মামলার বিচারের ক্ষেত্রে এ রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কারণ এ মামলায় ভিকটিম জীবিত আছেন। কিন্তু তিনি বেঁচে থেকেও মৃত। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয় আপিল বিভাগ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে। যাতে এ ধরনের বর্বর অপরাধ করতে অপরাধীরা নিরুৎসাহিত হন।

ইত্তেফাক/এমএএম