তরুণ নেতারা বেশি আবেগপ্রবণ কম দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, না বয়স্কদের চেয়ে তরুণ নেতারা বেশি উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন? এমন প্রশ্ন তোলার যৌক্তিক ও সঙ্গত কারণ রয়েছে। কারণ বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে নেতৃত্বের উপযুক্ত বয়স নিয়ে আলোচনাটা এখন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়গুলোর একটি। বিশেষত ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ৪২ বছরের ঋষি সুনাকের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে, রাজনৈতিক নেতাদের বয়সের পরিপ্রেক্ষিতে ৪০ বছর বয়সীদের হাতে বিশ্ব নেতৃত্বের বিষয়টি বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠছে। সুনাকের পূর্বসূরি ডেভিড ক্যামেরন ও লিজ ট্রাস যখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন তাদেরও বয়স ছিল ৪০-এর কোঠায়। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল; বিশেষ করে শুধু ইউরোপেই ৫০ বছরের কম বয়সী সরকারপ্রধান আছেন অন্তত ১৪ জন। ফলে ৪০-এর কোঠায় দাঁড়ানো ব্যক্তিরা রাষ্ট্র পরিচালনায় উত্তম অবস্থানে রয়েছেন কি না; বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে।
ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৪০-এর জয়জয়কার বেশি। যেমন, ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে ছয় দফা ঘোষণা করার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বয়স ছিল ৪৬ থেকে এক মাস দূরে। তাজউদ্দীন আহমদ ৪৫ বছর বয়সে মুজিবনগর সরকার গঠন করেছেন। একইভাবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম যখন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন তার বয়স ছিল ৪০-এর কোঠায়। ১৯৯১ সালে ৪৫ বছর বয়সে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হন। আর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ৪৮ বছর বয়সে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেন।
পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ৪৩ বছর বয়সে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের স্থলাভিষিক্ত হন। বিল ক্লিনটন ১৯৯১ সালে ৪৫ বছর বয়সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হন। পিয়েরে এলিয়ট ট্রুডো ১৯৬৮ সালে ৪৮ বছর বয়সে কানাডার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। আবার তার ছেলে জাস্টিন ট্রুডো ২০১৫ সালে ৪৪ বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এরও আগে, ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষের শেষ ভাইসরয় হিসেবে ৪৭ বছর বয়সী লর্ড মাউন্টব্যাটেন দেশ ভাগের সভাপতিত্ব করেন। ১৯৫৯ সালে ৪২ বছর বয়সে ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। আর ৪৯ বছর বয়সে ভারতের একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। তিনি নিহত হওয়ার পর উত্তরাধিকার হিসেবে ছেলে রাজীব গান্ধী ৪০ বছর বয়সে ক্ষমতায় আসেন।
চল্লিশের কোঠায় রাজনীতিতে উপভোগ করার একটি মুহূর্ত। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা তাদের চল্লিশের কোঠায় রাজনীতিতে তাদের ছাপ ফেলেছেন। যেমন দেশে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু যখন ১৯৮৮ সালে প্রথম যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৪১ বছর। তখন তার হাত ধরেই যুদ্ধাহত দেশের ভঙ্গুর যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক উন্নয়ন ঘটে।
চল্লিশের কোঠায় রাজনীতিতে একটা অন্যরকম গতি থাকে। এই সময় রাজনীতিবিদদের মাঝে নিজেকে প্রমাণ করার প্রবণতা বেশি থাকে। ফলে তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপে নতুন উদ্যম লক্ষ করা যায়। কিন্তু চলতি ধারণা হলো, রাজনীতিতে পোক্ত হওয়ার পরই রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া শোভন। তাই দেখা যায়, যিনি রাষ্ট্রপ্রধান হন, তার বয়সটা একটু ভারীই। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘কাঁচা' বয়সে রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে চমক সৃষ্টি করেছেন অনেক রাজনীতিবিদ। যেমন ২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি উত্তর কোরিয়ার জনগণ মাত্র ২৭ বছর বয়সী এক তরুণকে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে বরণ করে নেয়। সেই তরুণই আজকের রহস্যে ঘেরা নেতা কিম জং উন।
এদিকে, ভুটানের শতবছরের ঐতিহ্যবাহী রাজবংশের পঞ্চম রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক অল্প বয়সে রাজা নির্বাচিত হন। অর্থাৎ ২০০৮ সালে যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন তার বয়স মাত্র ২৬ বছর। তার হাত ধরেই ভুটানে আধুনিক গণতন্ত্রের জন্য একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। নির্বাচন হয়। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। ফ্রান্সের কনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০১৭ সালে ৩৯ বছর বয়সে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ দায়িত্ব নেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নপন্থী ম্যাক্রোঁর বিজয়ে ব্যাপক প্রভাব পড়ে পুরো মহাদেশটিতে।
২০১৭ সালের মার্চে বিশ্বের সবচেয়ে তরুণ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর সেবাস্তিয়ান কুর্জ। তখন তাঁর বয়স ছিল ৩১ বছর। তবে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর গত বছরের অক্টোবরে পদত্যাগ করেন তিনি। ২০১৯ সালে ৩৪ বছর বয়সী সান্না মারিনকে দেশের ৪৬তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেয় ফিনল্যান্ডবাসী।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে ৩৫ বছর বয়সে চিলির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন গাব্রিয়েল বরিচ। তিনিই এখন পর্যন্ত কনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট। ২০২২ সালের এপ্রিলে ৩৬ বছর বয়সে মন্টেনেগ্রোর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন দ্রিতান আবাজোবিক। ২০১৭ সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হন জেসিন্ডা আরডার্ন। বর্তমানে তাঁর বয়স ৪২ বছর। ২০১৯ সালের জুন মাসে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব আসেন ৪১ বছর বয়সী মেটে ফ্রেডেরিকসন।
ওয়ার্ল্ডোমিটারস ২০২১ সালে ২০০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছিল। প্রতিবেদনে দেশের জনসংখ্যার গড় বয়সের সঙ্গে রাষ্ট্রপ্রধানদের বয়সের তুলনা করা হয়েছিল। এখানে বলা হয়, ২০৫০ সাল নাগাদ পুরো বিশ্বের মোট জনসংখ্যার গড় বয়স হবে ৩৬ বছর। বর্তমানে তা ৩১ বছর। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৯টি ইউরোপীয় দেশে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের বয়সের সঙ্গে জনসংখ্যার গড় বয়সের মধ্যে পার্থক্য ১০ বছর বা তারও কম। ফলে ইউরোপে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান নির্বাচনে বয়সের প্রতিবন্ধকতা ভাঙার চেষ্টা করছে। এছাড়া, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নারী রাষ্ট্রপ্রধানদের বয়সের মধ্যেও বৈচিত্র্য দেখা গেছে। বর্তমানে ৩৭ বছর বয়সী সানা মারিন যেমন সবচেয়ে কম বয়সী নারী সরকার প্রধান, তেমনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (৭৪) সবচেয়ে বেশি বয়সী নারী সরকারপ্রধান।
ফোর্বসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতাদের কার্যকারিতা কমে যায়। তবে প্রচলিত ধারণার সঙ্গে এ তত্ত্ব সাংঘর্ষিক। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, বয়স্ক নেতারা তাঁদের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভালোভাবে দেশ চালাতে পারেন। ফোর্বসের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বয়স্ক মানুষদের মধ্যে অহঙ্কার ও আত্মতুষ্টির প্রবণতা বেশি হতে পারে। নিজেদের ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার ধারণাকে তাঁরা সাদরে না-ও গ্রহণ করতে পারেন।
মূলত জীবনের সাধারণ গতিতে, ৪০-এর কোঠা মানুষের জন্য একটি গাম্ভীর্যপূর্ণ-প্রাজ্ঞ সময়। ফলে রাজনৈতিক ইতিহাসে, চল্লিশের কোঠা মূলত রাজনীতিবিদদের শক্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সময় রাজনীতিবিদদের জন্য জাদুকরি মনোবল নিয়ে আসে। তাদের কর্মজীবনে ও জাতির প্রতি নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের সেরা সময় হয়ে ওঠে। প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার অগ্রগামী মনোভাব বা নতুন কিছু করার উদ্যমই তাদের ক্যারিশমেটিক ও গ্ল্যামারাস করে তোলে। ইতিহাসেও তাদের স্থান হয় পাকাপোক্তভাবেই।