শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রাজনীতির 'টাইটানিক' মাহাথিরের কেন ভরাডুবি হলো?

আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২২, ১৫:১৪

মালয়েশিয়ার গত ১৯শে নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে কোনো দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় ঝুলন্ত পার্লামেন্ট পেয়েছে দেশটি। এই নির্বাচনে মারাত্মকভাবে পতন হয়েছে মালয়েশিয়ার রাজনীতির জায়ান্ট হিসেবে পরিচিত মাহাথির মোহাম্মদের। তিনি মালয়েশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রধানমন্ত্রীই শুধু ছিলেন না, বরং আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার বলা হয় তাকে।

এর আগে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অসাধারণভাবে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন ড. মাহাথির। দেশটির আরেক রাজনীতিবিদ ও প্রায় ২৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে জোট বাধেন তিনি। ওই নির্বাচনে ৯২ বছর বয়সী মাহাথির মোহাম্মদ তার পুরনো দল ইউএমএনও-কে পরাজিত করেন।

বর্তমানে ৯৭ বছর বয়সী ড. মাহাথির আবার পার্লামেন্টের ভোটে দাঁড়ানোর পর নির্বাচনে জয় তো দূরের কথা তার নিজের এবং তার নতুন গঠিত দলের সব সবার জামানত পর্যন্ত বাতিল হয়েছে। কারণ তার আসনে যত ভোট পড়েছে তার এক অস্টমাংশ আদায় করতে পারেনি তিনি। এছাড়া তার দল কোনো আসনে জয়লাভ করেনি। গত ৫৩ বছরে এটাই মাহাথির মোহাম্মদের প্রথম কোনো নির্বাচনে পরাজয়ের ঘটনা। 

রাজনৈতিক জীবন

মাহাথির মোহাম্মদ ১৯৮১ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত টানা ২২ বছর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮০-এর দশকে মালয়েশিয়ার ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং রূপান্তরের জন্য তাকেই কৃতিত্ব দেওয়া হয়।

২০১৮ সালে অবসর থেকে আবারো রাজনীতিতে ফেরেন তিনি। যার উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাককে ক্ষমতাচ্যূত করা। নাজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় তহবিল আত্মসাতের অভিযোগ ছিল।

সাবেক বিরোধী নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে জোট বেঁধে মাহাথির আবারও দেশটির ক্ষমতায় আসেন। সেসময় নাজিবকে অর্থ পাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে দণ্ডিত করা হয় এবং তাকে কারাবাসেও পাঠানো হয়।

তবে জোটের মধ্যে অন্তর্কোন্দল থাকার কারণে শেষ পর্যন্ত আর জোটবদ্ধ থাকতে পারেননি মাহাথির ও আনোয়ার। ফলশ্রুতিতে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঘটনার টানাপোড়েনের জেরে ক্ষমতাসীন পাকাতান হারাপান জোটের পতন ঘটে এবং মাহাথির ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়েন।

যাই হোক না কেন, দুইবারের প্রধানমন্ত্রী মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র যদিও তার শাসনামল বেশ জটিল।

যেখান থেকে শুরু

২১ বছর বয়সে ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন নামে একটি রাজনৈতিক দলে যোগ দেন, যেটির সংক্ষিপ্ত রূপ ইউএমএনও। দলটি আমনো নামে বেশি পরিচিত। সে সময় ডাক্তারি পেশায় ছিলেন তিনি। রাজনীতির পাশাপাশি নিজের এলাকায় সাত বছর ধরে ডাক্তারি পেশার চর্চ্চা করেন তিনি।

১৯৬৪ সালে তিনি পার্লামেন্ট সদস্য হন। এরপর ১৯৬৯ সালে তিনি তার আসন হারান এবং তাকে দল থেকে বরখাস্ত করা হয়। কারণ তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টানকু আব্দুল রহমানকে আক্রমণ করে একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন। 

এরপর তিনি মালয় ডিলেমা নামে একটি বির্তকিত বই লিখেন। যেখানে তিনি দাবি করেন যে, দেশটিতে মালয় জাতি আসলে কোণঠাসা এবং তিনি তাদের এই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক অধিকার অবলীলায় মেনে নেওয়ার জন্য সমালোচনা করেন।

তার এই মত ইউএমএনও দলের ভেতরে থাকা তরুণ নেতাদের প্রভাবিত করে এবং তারা তাকে আবার দলে ডেকে পাঠান। ১৯৭৪ সালে তিনি আবারও পার্লামেন্ট সদস্য হন। সেই বছরই তাকে শিক্ষামন্ত্রী করা হয়। এরপর মাত্র চার বছরে তিনি ইউএমএনও দলের উপনেতা হন এবং ১৯৮১ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন।

তার শাসনামলে মালয়েশিয়া ১৯৯০ এর দশকে পরিচিত এশিয়ান অর্থনৈতিক টাইগার বা সবল অর্থনৈতিক দেশের তালিকায় উঠে আসে। তার কর্তৃত্ববাদী কিন্তু বাস্তবমুখী নীতির কারণে মালয়েশিয়ার ঘরে ঘরে তার জনপ্রিয়তা বাড়ে। তবে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কিছু অভিযোগের কারণে কিছুটা ক্ষোভও ছিল বটে।

গণতন্ত্রের প্রতি উদাসীনতা

মালয়েশিয়ার অভ্যন্তরে সর্বাধিক সমালোচিত নিরাপত্তা আইনের আওতায় বিরোধীদলীয় নেতাদের বিচার ছাড়াই কারাবাস দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ১৯৯৮ সালে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের ডাক দেয়ায় তার উপ-প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমকে দুর্নীতি এবং সমকামীতার জন্য বরখাস্ত করা হয় এবং পরে সমকামীতার অভিযোগে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। 

পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে প্রায়শই তীক্ষ্ম মন্তব্য করার কারণেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি পান মাহাথির মোহাম্মদ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০০৩ সালের অক্টোবরে পদত্যাগের আগে তিনি বেশ কয়েকটি সরকার এবং ইহুদী গোষ্ঠীর বিরাগভাজন হয়েছিলেন এই বলে যে, একটি ইহুদি কাবাল বা আদর্শ “দুনিয়া শাসন করছে।”

রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন না হওয়া

অবসরে যাওয়ার পর মাহাথির মোহাম্মদ আসলে কখনো পুরোপুরি রাজনৈতিক পরিধির বাইরে থাকেন নি। তিনি তার উত্তরাসূরী আব্দুল্লাহ বাদাওয়ীকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন।

২০০৮ সালে ক্ষমতাসীন জোটের নিষ্প্রভ নির্বাচন ফলের পর তিনি ওই জোট ত্যাগ করেন। যা আব্দুল্লাহকে ক্ষমতা ছাড়ার বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করেছিল বলে মনে করা হয়। আর এটিই নাজিবের ক্ষমতায় আসার পথও সুগম করেছিল।

নাজিবের প্রতি মাহাথিরের প্রাথমিক সমর্থন পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ তহবিলে বিশালাকার দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসার পর। যা ওয়ান মালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট বারহাদ নামে পরিচিত।

নাজিবের বিরুদ্ধে দলীয় এবং সরকারের অভ্যন্তর থেকেই মামলা করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে তিনি আমনোর সমর্থকদের যথেষ্ট সমর্থন জুগিয়েছিলেন। কিন্তু পরে কোন উপায় না দেখে তিনি এবং দলের কয়েক জন শীর্ষ নেতা আমনো ত্যাগ করেন এবং ২০১৬ সালে বিরোধীদলে যোগ দেন।

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে তিনি ৯২ বছর বয়সে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। একই বছরের মে মাসে তিনি ঐতিহাসিক জয় পান এবং তার সাবেক মিত্র জোটকে ক্ষমতাচ্যুত করেন যারা এর আগে প্রায় ৬০ বছরের বেশি দেশটি শাসন করেছে। 

তিনি আনোয়ার এবং আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে মিলে সাবেক জোট পাকাতান হারাপান গঠন করেন যা ভেঙ্গে যাওয়ার আগে দুই বছর দেশটিকে শাসন করেছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আনোয়ারের সাথে জোট ভেঙে পদত্যাগ করার সময় মালয়েশিয়াকে রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থার দিকে ঠেলে দেন।

পদত্যাগের পর, তিনি এবং  আনোয়ার ঘোষণা করেন যে তারা আবারও জোটবদ্ধ হয়েছেন এবং তারা জনগণের সমর্থনের আহ্বান জানান। কিন্তু দেশটির রাজা সুলতান আব্দুল্লাহ সুলতান আহমাদ শাহ যিনি আসলে সিদ্ধান্ত নেন যে কারা সরকার গঠন করবে, তিনি মি. মুহিদ্দিনকে বেছে নেন।

মুহিদ্দিন একজন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যিনি নিজেকে এক সময় তার বিতর্কিত “মালয় প্রথম” এবং “মালয়েশিয়ান দ্বিতীয়” মতবাদ ঘোষণা করেছিলেন। তবে তার শাসনও স্থায়ী হয়নি। গত বছরের অগাস্টে মাত্র ১৭ মাসের শাসন শেষে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ট সমর্থন না থাকায় তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। তার স্থলাভিষিক্ত হন বর্তমান প্রিমিয়ার ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব।

নির্বাচনে ভরাডুবি যে কারণে

অ্যামিরেটাস প্রফেসর আব্দুর রশীদ মতিন বলেন, মাহাথির মোহাম্মদ মনে করেছিলেন যে, যেহেতু মালয়েশিয়ায় অন্যান্য রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগে মামলা চলছে এবং তার বিরুদ্ধে যেহেতু এরকম কোন অভিযোগ নেই, তাই সাধারণ জনগণ হয়তো তাকে সমর্থন দেবেন।

তবে তার এই অনুমান ভুল ছিল বলে মনে করেন এই রাজনীতি বিশ্লেষক।

তার মতে, মাহাথিরের ইমেজ কিছুটা স্বচ্ছ বা ক্লিন থাকলেও তার আসলে কোন ব্যাকআপ ছিল না। দেশটির অন্য যেসব রাজনৈতিক দল ও জোট রয়েছে তারা কেউই এবার নির্বাচনে মাহাথির মোহাম্মদকে সমর্থন দেয়নি। যার ফলে, অনেকটা একাকী হয়ে পড়েছেন তিনি।

“তিনি মনে করেছিলেন যে সবাই তাকে ভোট দেবে এবং উনি দাঁড়াবেন, দাঁড়িয়ে মালয়েশিয়ার রাজনীতিকে ঠিক পথে আনার চেষ্টা করবেন। কিন্তু আসল হলো যে উনার কোন ব্যাকিং (সমর্থন) নাই।”

তিনি বলেন, গতবার পারিকাতান যারা পিকেআর নামে পরিচিত ছিলেন তারা মি. মাহাথিরকে সমর্থন করেছিল। তার আগে তিনি আমনোর প্রেসিডেন্ট ছিলেন, আমনোও তাকে সমর্থন করেছে। কিন্তু এবার কেউ নেই।

রাজনৈতিক দল ও জোটের সমর্থনহীন হয়ে পড়ার কারণেও এবারের নির্বাচনে মাহাথির মোহাম্মদের ভরাডুবি হয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লষকেরা।

আব্দুর রশীদ মতিন বলেন, বারিসান ন্যাশনালে তিনি যাবেন না। কারণ এর আগে দুইবার বারিসান ন্যাশনালে তাকে নেয়ার পর তিনি সেখান থেকে ফিরে এসেছেন। এছাড়া আমনোর সাথেও তার যোগাযোগ নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি।

পারিকাতানের আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথেও মনোমালিন্য ছিল তার। কারণ এর আগের নির্বাচনে মি. মাহাথিরের দুই বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি আর সেটি করেননি। যার কারণে দূরত্ব তৈরি হয় পারিকাতানের সাথেও এবং আনোয়ার ইব্রাহিম তাকে সমর্থন দিতে অসম্মতি জানান।

অন্যদিকে আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার কারণেও মাহাথিরের প্রতি অসন্তোষ তৈরি হয়। তবে এমন অবস্থায় তার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ আসার আগে নিজেই পদত্যাগ করেন।

মি. মতিন বলেন, “মাহাথির আসলে মন থেকে কখনোই আনোয়ার ইব্রাহিমকে সমর্থন করেননি। এটা তার জীবনী পড়লেই বোঝা যায়। যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন যে আনোয়ার ইব্রাহিম কী কী করেছেন এবং কেন তাকে তিনি সমর্থন করেন না।”

তার মতে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাককে ক্ষমতা থেকে অপসারণের উদ্দেশ্যেই আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। কারণ নাজিব রাজাকের তুলনায় আনোয়ার ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলনামূলক কম ছিল।

নতুন দল

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মাহাথির মোহাম্মদ পারিকাতান দলে যেতে চাইলেও দলটির বর্তমান নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম তাকে দলে অন্তর্ভূক্ত করতে অস্বীকার করেন। ফলে কোন রাজনৈতিক দল না পেয়ে মাহাথির মোহাম্মদ নিজেই ২০২০ সালের অগাস্ট মাসে পাজুয়াং তানা এয়ার বা জাতীয় যোদ্ধা দল নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন।

এই রাজনৈতিক দল গঠন করার পর তিনি এই নির্বাচনে অংশ নেন।

প্রফেসর আব্দুর রশীদ মতিন বলেন, একটা দলের যে সমর্থন দরকার সেই সমর্থনও তার নেই। তাছাড়া তার নতুন গঠিত রাজনৈতিক দলের অনুসারীর সংখ্যাও ছিল উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কম।

“(ফলে) উনি যখন নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন, তখন লোকজন ওনাকে ভোট দেয়নি।” মাহাথির মোহাম্মদতো বটেই, তার দলের কোন সদস্যই কোন আসনে জয়ী হননি। উল্টো তাদের নির্বাচনের জামানতও বাজেয়াপ্ত হয়েছে।

কারণ তার আসনে যত ভোট পড়েছে তার এক অস্টমাংশ আদায় করতে পারেননি তিনি। মতিন বলেন, নির্বাচনে জয়ী হতে হলে একটা বড় রাজনৈতিক দলের সমর্থন দরকার। এখন উনি অগাস্টে দল গঠন করে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে কিভাবে আশা করেন যে, ওই দল তাকে বিজয়ী করবে?

এটা মি. মাহাথিরের একটা ভুল বলে মনে করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এছাড়া মি. মাহাথির বর্তমানে ৯৭ বছর বয়সী। এটাও তার প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাওয়ার একটা কারণ হতে পারে বলে মনে করেন অনেকে। ইউনিভার্সিটি অব নটিংহাম মালয়েশিয়ার শিক্ষক ব্রিজেট ওয়েলশের ভাষায়, “মাহাথিরের সময় পেরিয়ে গেছে।”

তরুণ ভোটার

মালয়েশিয়ায় শুধু মাহাথির মোহাম্মদ নন, বরং আরো কয়েক জন শীর্ষ রাজনীতিবিদ এই নির্বাচনে হেরে গেছেন। এর কারণ হিসেবেপ্রফেসর মতিন মনে করেন, মালয়েশিয়ায় তরুণ ভোটারদের উত্থানই এই পরিবর্তন এনেছে।

মালয়েশিয়ার বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এবার নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন প্রায় ৬০ লাখ তরুণ ভোটার। যাদের বয়স ১৮-২১ বছরের মধ্যে। প্রফেসর মতিন বলেন, এই তরুণ ভোটাররা জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদদের প্রতি সমর্থন নয় বরং তরুণ নেতৃত্ব দেখতে আগ্রহী। আর এ কারণেই জ্যেষ্ঠ অনেক রাজনীতিবিদ ভোটের দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছে বলে মনে করেন তিনি।

“ওরা জানেই না যে আগে কী হয়েছে, কে কী করেছে, ৩০ বছর আগে কী হলো ওদের তো কোন পাত্তা নেই,” বলেন তিনি। “ওরা চাচ্ছে যে নিউ ব্লাড (নতুন রক্ত) আসুক।”

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, মালয়েশিয়ায় তরুণদের নিয়ে নতুন একটি দল গঠন করা হয়েছে মালয়েশিয়ান ইউনাইডেট ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স বা সংক্ষেপে মুডা। যার অর্থ “তরুণ দল”। এই দলের নেতা ২৯ বছর বয়সী সাইদ সাদিক সাইদ আব্দুল রহমান।

মূলত মালয়েশিয়ার জোট রাজনীতির চক্র থেকে বের হওয়ার মন্ত্র নিয়েই এই রাজনৈতিক দলের জন্ম। গত ১৯শে নভেম্বরের নির্বাচনে তরুণ এই রাজনৈতিক নেতা জয়লাভও করেছেন।

হতাশা

২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর মাহাথির মোহাম্মদের শাসনের প্রথম ২০ মাস হতাশাপূর্ণ ছিল বলে সমালোচনা রয়েছে। মাহাথিরের সরকারের নির্বাচন পূর্ববর্তী প্রতিশ্রুতি এবং ক্ষমতায় আসার পর সেগুলো পূরণের হিসাব রাখছিল হারাপান ট্র্যাকার নামে একটি ওয়েবসাইট। ওয়েবসাইটটি বলছে, মাহাথিরের সরকার নির্বাচনের আগে ৫৫৬টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আর ৬৮৫ দিন ক্ষমতায় থাকার সময় তারা এর মধ্যে মাত্র ২৬টি পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিল। একশ বাইশটি প্রতিশ্রুতি পূরণে কাজ চলছিল এবং বাকি ৪০০টির কোন কাজই শুরু হয়নি।

সাধারণ মালয়েশিয়ানদের কাছে যা ছিল খুবই হতাশাজনক। কারণ তারা পরিবর্তনের আশায় ভোট দিলেও তা পূরণ না হয়ে উল্টো তাদের জীবযাত্রার ব্যয় বেড়েই যাচ্ছিল।

তাদের এই হতাশার প্রকাশ ঘটে বেশ কয়েকটি উপ-নির্বাচনে যেখানে মাহাথিরের পাকাতান পার্টির প্রার্থীদের বদলে ক্ষমতায় আসে বিরোধী জোট আমনোর প্রার্থীরা। এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ না বাড়া, চাইনিজ মালয়েশিয়ানদেরকে দেশটির রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোকেও ভাল চোখে দেখেনি অনেকে।

মাহাথিরের এসব পদক্ষেপও তার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাভঙ্গের কারণ বলে দ্য এশিয়ান পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বলা হচ্ছে যে, মাহাথির মোহাম্মদের রাজনৈতিক টাইটানিক আসলে বিরোধী নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথে সংঘর্ষে ডুবে গেছে।

যাকে তিনি নিজের ডেপুটির পদ থেকে ১৯৯৮ সালে সমকামিতার অভিযোগে বরখাস্ত করেছিলেন, তিনিই এবার চালকের আসনে। উনিশশো নব্বই এর দশকের পর থেকে তিনিই মালয়েশিয়ার রাজনীতির পট পাল্টে দিয়েছেন। বিবিসি 

ইত্তেফাক/এসআর