গত দুই দশকে গঙ্গায় পানির মোট পরিমাণ কমেছে। শুধু গঙ্গা নয়, নদীর অববাহিকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। মঙ্গলবার (২৯ নভেম্বর) জাতিসংঘের শাখা সংস্থা ওয়ার্ল্ড মেটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএমও) এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। হিন্দুস্তান টাইম্সের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
ডব্লিউএমও তাদের 'স্টেট অফ গ্লোবাল ওয়াটার রিসোর্স ২০২১' শীর্ষক রিপোর্টে জানিয়েছে, ২০০২ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে গঙ্গা নদীর পানির পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে গেছে। গঙ্গা অববাহিকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও কমেছে।
শুধু গঙ্গা নয়, দক্ষিণ আমেরিকার প্যাটাগোনিয়ার সাও ফ্রান্সিসকো নদীর অববাহিকা, সিন্ধু নদীর অববাহিকা এবং আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিমে বিশাল নদীর অববাহিকায় একই ধরনের নিদর্শন দেখা গেছে। তবে নাইজার নদী অববাহিকা ও উত্তর আমাজন নদী অববাহিকায় এর বিপরীত চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। সেখানে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।
ডব্লিউএমওর রিপোর্ট অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের ভূ-পৃষ্ঠের পানির সম্পদকে প্রভাবিত করছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে হিমবাহ গলে যাওয়ায় নদীতে পানির পরিমাণ বাড়লেও এক সময় পর তা কমতে শুরু করে। হিমবাহ গলনের প্রভাব এখন সিন্ধু অববাহিকা ও গঙ্গা নদীর অববাহিকা অঞ্চলে অনুভূত হচ্ছে।
হিমবাহের বরফ কমা অব্যাহত থাকায় উত্তরাখণ্ডের মতো অঞ্চলগুলো একটি সময়ের পরে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হবে। অন্যদিকে, নিম্ন ধারার অঞ্চলগুলো যেমন পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলো কৃষিকাজ ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রার জন্য অত্যধিক ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে দ্রুত কমে যাচ্ছে।
ভারতের পরিবেশ বিজ্ঞানী ও কেন্দ্রীয় ভূ-বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের সচিব এম. রাজীবন মনে করেন, ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার কমাতে সরকারের এখনই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদীর পানির উচ্চতা বাড়লেও এসব অঞ্চলে উচ্চ তাপমাত্রার কারণে পানি দ্রুত বাষ্পে পরিণত হচ্ছে। ভবিষ্যতে এটি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
মাটিতে সঞ্চিত পানির পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে ডব্লিউএমও। প্রতিবেদনটিতে মাটিতে আর্দ্রতার পরিমাণ, ভূগর্ভস্থ পানি, বরফ, উদ্ভিদে সঞ্চিত পানি, নদী ও হ্রদের পানি বিবেচনা করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্যাটাগোনিয়া, উত্তর আফ্রিকা, মাদাগাস্কার, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অংশ, মধ্য দক্ষিণ আমেরিকা, পাকিস্তান ও উত্তর ভারতে সঞ্চিত পানির পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কম। কিছু এলাকায় তা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম।
অন্যদিকে আফ্রিকার মধ্যাঞ্চল, দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে আমাজন অববাহিকা ও চীনের উত্তরাঞ্চলে সঞ্চিত পানির পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। প্রতিবেদনে অঞ্চলগুলোতে পানির উচ্চতার উপাদানের কারণ হিসেবে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে হিমবাহের গলন উল্লেখ করা হয়েছে।
অন্যদিকে প্রতিবেদনে নদী ও ভূগর্ভস্থ পানির অত্যধিক ব্যবহারকে অঞ্চলে নিম্ন ভূগর্ভস্থ পানি সঞ্চয়ের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ২০২১ সালে বিশ্বের অনেক জায়গায় বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে কম ছিল। এটি লা নিনা ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হয়েছে।
লা নিনা নিরক্ষীয় প্রশান্ত মহাসাগরের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা কমিয়ে দেয়। একই সময়ে লা নিনা গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটায়। এর ফলে বৃষ্টিপাতের তারতম্য ঘটে। কোথাও বৃষ্টির পরিমাণ কমেছে, আবার কোথাও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। লা নিনার কারণে ভারতের মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি রাজ্যকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে ৪০০ টিরও বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটেছে। মোট ক্ষয়ক্ষতি ২৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। প্রায় ১০ হাজার মানুষ মারা গেছেন। বিশ্বের ১০ কোটি জনবসতি এর ফলে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত হয়েছে।
গত বছর বিশ্ব গড় তাপমাত্রা এক ডিগ্রির বেশি বেড়েছে। ২০২১ সাল রেকর্ডে সপ্তম উষ্ণতম বছর হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল। লা নিনার বিপরীত হল এল নিনো। এর ফলে নিরক্ষীয় প্রশান্ত মহাসাগরের উপরের অংশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। ফলে স্বাভাবিকের থেকে বৃষ্টিপাত কম হয়। বন্যা ও খরার প্রাদুর্ভাবও বেশি হয়। ভারতে যেমন এল নিনোর প্রভাব খরার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে, লা নিনা প্রভাব বৃষ্টিপাত বাড়ায় ও শীতকে দীর্ঘস্থায়ী করে।
এই প্রথম বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা এমন রিপোর্ট প্রকাশ করল। ডব্লিউএমওর দাবি, তারা মূলত নাসার গ্রেস মিশন থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশ্বের সব দেশে কী করণীয় সে বিষয়েও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।