শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

আইন ছাড়াই বাড়ছে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের পরিধি

আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২২, ০৭:০৩

আইন ছাড়াই বড় হচ্ছে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের পরিধি। দেশে ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে আমানত ও ঋণের হিসাবে দেখা গেছে এক-চতুর্থাংশই ইসলামি ব্যাংকগুলোর দখলে রয়েছে। এখন পুরোদমে ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাচ্ছে ১০টি ব্যাংক। দেশে ইসলামি ব্যাংক পরিচালনার কোনো আইন নেই এবং এ জন্য পূর্ণাঙ্গ কোনো নীতিমালাও নেই—এটা নিয়ে কমবেশি কথা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে ১৪ থেকে ১৫টি বাণিজ্যিক ব্যাংক পুরোপুরি ইসলামি ব্যাংকিং করতে চায়। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই সক্ষমতা নেই। সেই ধরনের লোকবলও নেই। যারা ইসলামি ব্যাংকিং করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা মূলত তাদের কাছ থেকেই প্রথমে শিখছে। প্রচলিত আইনেই ইসলামি ব্যাংকিংয়ের বিষয়ে বলা আছে। এ কারণে ইসলামি ব্যাংকিং করতে তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এছাড়া ইসলামি ব্যাংকিংয়ের জন্য একটি গাইডলাইন আছে। সেই গাইডলাইন অনুযায়ী ব্যাংক চলছে কি না তা দেখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরিং ব্যবস্থাও রয়েছে।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডর শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, আইন থাকলে সব দিক দিয়েই ভালো হবে। এ বিষয়ে একটি গাইডলাইন আছে। যদিও এটি সংসদে পাশ হয়নি তবে ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতে এটি ভালোভাবেই মেনে চলছে। আইনটি থাকলে সেক্টরটি আরো পাকাপোক্ত হবে এবং ইসলামি ব্যাংকিংয়ের জন্য ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। গ্রাহকদের আত্মবিশ্বাস আরো বাড়বে। ইসলামি ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতে যারা কাজ করছেন তারাও নিরাপদ অনুভব করবেন যে, তারা যা করছেন তা আইনগতভাবে স্বীকৃতি দেওয়া আছে। এখন যেসব টারমোলজি ব্যবহার করা হচ্ছে তা গাইডলাইন অনুযায়ী। আইন হলে তা আইন অনুযায়ী ব্যবহার করা যাবে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আসলে ইসলামি ব্যাংকিং হলো কাগজে কলমে। বাস্তবে ইসলামি ব্যাংকিং মানা হয় না। মানার চেষ্টাও নেই। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির কারণে দেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের বাজার বড় হচ্ছে। ইসলামি ব্যাংকের জন্য পৃথক আইন এখন সময়ের দাবি।

জানা গেছে, ইসলামি ব্যাংক চালু হওয়ার এক বছর আগে ‘ইসলামি ব্যাংকিং আইন’ চালু করেছিল থাইল্যান্ড। অথচ বাংলাদেশে ৪০ বছরেও ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে আসলেও এখন পর্যন্ত এ-সংক্রান্ত আইন চালু করা যায়নি। ২০১১ সালে অর্থবিষয়ক স্থায়ী কমিটির কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি খসড়া আইন চূড়ান্ত করে জমা দিয়েছিল। কিন্তু এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ইত্তেফাককে বলেন, প্রত্যেকটি ইসলামি ব্যাংকের একটি সরিয়া বোর্ড আছে। আলাদাভাবে আইন করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং শরিয়া বোর্ডের ভূমিকা কী হবে এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে। কিছু দেশে আলাদা আইন আছে। আইনের প্রয়োজন আছে কিংবা নেই যারা ব্যাংকার নয় কিন্তু ইসলামি ব্যাংক নিয়ে দেশেবিদেশে কাজ করে আইন বিষয়ে তাদের মতামত নেওয়া যেতে পারে। সব মিলে আমানতকারীদের সুরক্ষার বিষয়টি দেখতে হবে।    

বিশ্বে ব্যাংক ব্যবস্থা ৬০০ বছর আগে যাত্রা শুরু করলেও ইসলামি ধারার ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু হয় ১৯৬৩ সালে। আর বাংলাদেশে তা শুরু হয় ১৯৮৩ সালে দেশিবিদেশি উদ্যোগ ও সরকারি-বেসরকারি মালিকানায় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আরো অনেক ব্যাংক বিশেষায়িত শাখা ও উইন্ডো খোলার মাধ্যমে ইসলামি ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। এ ছাড়া অন্য অনেক প্রচলিত ব্যাংকও এখন ইসলামি ধারার সেবা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর শেষে বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতের মোট আমানত ও ঋণের ২৩ দশমিক ৪০ শতাংশ হচ্ছে ইসলামি ব্যাংকগুলোর। দেশে ইসলামি ধারার ব্যাংকিং শিক্ষার কোনো কাঠামোও গড়ে ওঠেনি। ফলে প্রচলিত ধারার ব্যাংকাররাই পরিচালনা করছেন ইসলামি ধারার ব্যাংকিং কার্যক্রম।

ইসলামি ও প্রচলিত ব্যাংকের মধ্যে পার্থক্য : প্রচলিত ধারা এবং ইসলামি ধারার ব্যাংক ব্যবস্থার মূল পার্থক্য সুদ এবং মুনাফার ক্ষেত্রে। ইসলামি ধারার ব্যাংকিংয়ে বলা হয়, ‘প্রফিট-লস-শেয়ারিং’ অর্থাৎ ব্যাংক যেহেতু গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত রাখছে, ব্যাংকের যদি লাভ হয় তাহলে আমানতের ওপর গ্রাহক লভ্যাংশ পেতে পারে। কিন্তু ব্যাংকের যদি ক্ষতি হয় তাহলে গ্রাহক লভ্যাংশ পাওয়ার জন্য যোগ্য হবে না। এটাই প্রচলিত এবং ইসলামি ব্যাংকের মধ্যে মূল পার্থক্য। এক্ষেত্রে আগে থেকেই গ্রাহককে প্রচলিত ব্যাংকের মতো লিখিত কোনো কাগজে লিখে দেবে না যে কত শতাংশ মুনাফা সে পাবে। কিন্তু ইসলামি ব্যাংকের ক্ষেত্রে মৌখিকভাবে মুনাফার একটা শতাংশের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। ইসলামি ধারার ব্যাংকিংয়ে কয়েকটি দিক রয়েছে। যেমন—মুদারাবা কনসেপ্ট- মুনাফার অংশীদারিত্ব, মুরাবাহা- লাভে বিক্রি (লোনের ক্ষেত্রে), এবং মুসারাকা- লাভ। বাংলাদেশে যে ১০টা ইসলামি ব্যাংক রয়েছে তাদের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে ব্যাংকগুলো পরিচালিত হচ্ছে শরিয়া অনুযায়ী এবং তাদের কার্যক্রম জনকল্যাণমুখী। বাংলাদেশের সব ইসলামি ব্যাংক পর্যবেক্ষণের জন্য রয়েছে কেন্দ্রীয় শরিয়া বোর্ড।

যেভাবে চলছে কার্যক্রম : কোম্পানি পরিচালনার জন্য ১৯৯১ সালে ব্যাংক-কোম্পানি আইন করা হয়। এই আইনের মধ্যে শরিয়ার রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ধারায়। দেশের পুঁজিবাজারে ইসলামি ব্যাংক কীভাবে অংশ নেবে এবং ইসলামি সুকুক বন্ড সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন সার্কুলারে বলা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ২০০৯ সালে তারা একটা গাইডলাইন তৈরি করেছে সেখান থেকে রেফারেন্স নিয়ে ইসলামি ব্যাংক পরিচালনা করা যায়। তবে আর্থিক খাত বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসলামি ব্যাংকগুলোর জন্য একটা কার্যকরী আইন দরকার, যাতে করে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হলে সেই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

দেশের ব্যাংক খাতের অনেক কিছুর শীর্ষে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল)। দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করেছে এই ব্যাংক। বিদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয়ও আসে ব্যাংকটির মাধ্যমে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের নভেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট আমানত ছিল ১৬ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামি ব্যাংকগুলোতে রয়েছে ৩ লাখ ৮১ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ আমানতের ২৩ দশমিক ৪০ শতাংশই ইসলামি ব্যাংকগুলো পেয়েছে। এর মধ্যে আইবিবিএলের আমানতই ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। নভেম্বরে ব্যাংক খাতের ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামি ব্যাংকগুলোর অংশ ছিল ৩ লাখ ৭১ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশে এখন প্রবাসী আয়ের ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশই আসে ইসলামি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। সবচেয়ে বেশি আসে আইবিবিএলের মাধ্যমে। তাদের অংশ ২৪ দশমিক ২৮ শতাংশ।  সাধারণ ব্যাংকের চেয়ে ইসলামি ব্যাংকগুলোর ব্যবসা দ্রুত বড় হচ্ছে। এ নিয়ে ইসলামি ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা বলেন, ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেই মূলত গ্রাহকরা ইসলামি ব্যাংকে আসেন।

দেশে ইসলামি ব্যাংকগুলোর শাখার সংখ্যা ১ হাজার ২২১টি, যেখানে দেশের গোটা ব্যাংক খাতে শাখার সংখ্যা ১০ হাজার ৪০৬টি। এছাড়া আটটি প্রথাগত ব্যাংকের ৬১টি ইসলামিক ব্যাংকিং উইন্ডো দেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

 

ইত্তেফাক/ইআ