শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ভরা মৌসুমে কক্সবাজারে পর্যটকের খরা

আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯:২৪

কক্সবাজারে পর্যটনের ভরা মৌসুমেও পর্যটকের আগমন আশানুরূপ নয়। এই সময়টাতে বালিয়াড়ি ও আশপাশের পর্যটন স্পটগুলো লোকে লোকারণ্য  থাকার কথা থাকলেও বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। হাতেগোনা কিছু পর্যটকের উপস্থিতিতে হোটেল মোটেলগুলোতে আশানুরূপ ব্যবসা হচ্ছে না। ফলে লগ্নি ফিরে আসা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা। সেন্টমার্টিনে ভ্রমণ সংকুচিত হওয়াসহ নানা কারণে এবার কক্সবাজারে পর্যটক সমাগম কমেছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

কক্সবাজার হোটেল-গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার বলেন, কাগজে কলমে সেপ্টেম্বরের শেষ সময় থেকেই পর্যটন মৌসুম। নভেম্বরের শেষ আর ডিসেম্বরের শুরুতে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে ভ্রমণপিপাসু পরিবারগুলো কক্সবাজারে আসেন, সেন্টমার্টিন ভ্রমণে যান। করপোরেট অফিসগুলোর অনেকে বার্ষিক কনফারেন্সগুলো কক্সবাজারেই করে। এখন মৌসুমের মাঝামাঝি সময় চললেও পর্যটকের খরা চলছে বলা যায়। বিগত সময়ে বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে পর্যটকে টইটম্বুর হতো কক্সবাজার। অনেক পর্যটক হোটেলে রুম না পেয়ে সড়কের কিনারে, বালিয়াড়ি, গাড়িতে রাত কাটানোর চিত্রও অতীতে সবাই দেখেছে, কিন্তু শুক্রবার বিজয় দিবস এবং শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকলেও হাতেগোনা পর্যটক এবার কক্সবাজারে এসেছেন। বুকিং ছিল মাত্র ১৫-২০ শতাংশ রুম। তাই আমরা খুবই হতাশ। ধারদেনা করে পর্যটন ব্যবসায়ে লগ্নিকারীদের অনেকেই এখন কীভাবে ঋণ পরিশোধ করবেন, তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন।   

হোটেল-মোটেল অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ও হোয়াইট অর্কিড হোটেলের জেনারেল ম্যানেজার রিয়াদ ইফতেখার বলেন, সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারে সৈকতের বালিয়াড়িতে লোকজনের ভিড় বাড়ে। এবার ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস এবং সাপ্তাহিক ছুটি একই দিন পড়েছে। এতেও আগের মতোই লোকসমাগম হয়েছে। বালিয়াড়িতে ভিড় বাড়লেও সকলেই পর্যটক নন। এখানে সৈকত দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশি, যারা কক্সবাজার শহর কিংবা আশপাশের এলাকা থেকে আসেন আর সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে যান।

ট্যুরস অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজার (টুয়াক) সভাপতি মো. রেজাউল করিম বলেন, কক্সবাজার বেড়াতে আসা পর্যটকদের ৭০ শতাংশ সেন্টমার্টিনের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে যান। সেই হিসেবে গত কয়েক দশক ধরে মূলত প্রবালদ্বীপকে ঘিরেই কক্সবাজারে পর্যটন ব্যবসা চলছে। কিন্তু চলতি মৌসুমে অদৃশ্য কারণে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে। সেটা জেনেই কক্সবাজারে পর্যটক আসা কমেছে। টেকনাফ-সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচল শুরু না হলে মৌসুমের বাকি সময়ও একইভাবে মন্দা যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

সুগন্ধা ঝিনুক মার্কেট সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম বলেন, অনেক গণমাধ্যম আমাদের পর্যটনকে ধ্বংসের দ্বারপান্তে নিয়ে যাচ্ছে। সৈকতের বালিয়াড়িতে লোক উপস্থিতি দেখলেই প্রতিবেদন করে ?‘পর্যটকে ভরপুর কক্সবাজার।’ কিন্তু কারা পর্যটক এবং কারা দর্শনার্থী এটা পৃথক করার সক্ষমতা অনেকেই রাখেন না। এতে কক্সবাজারে পর্যটনব্যবসা নষ্ট হচ্ছে। আমরা যারা পর্যটনকে উপলক্ষ্য করে ঋণ নিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় লগ্নি করেছি তাদের সর্বস্ব হারানোর উপক্রম হয়েছে।   

সি-ক্রোজ অপারেটরস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (স্কোয়াব) সভাপতি তোফায়েল আহমদ বলেন, প্রতি বছর টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে ১০টি পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল করে। কিন্তু এবার কক্সবাজার থেকে কর্ণফুলী জাহাজটি ছাড়া টেকনাফ থেকে কোনো জাহাজ চলাচল করছে না। কর্ণফুলী জাহাজে সেন্টমার্টিন ভ্রমণ ব্যয়বহুল। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পর্যটকরা এটাতে ভ্রমণ করতে পারেন না। এছাড়া কর্ণফুলী জাহাজের ধারণক্ষমতাও কম। তাই কক্সবাজারে মধ্য ও নিম্নবিত্ত পর্যটকের আগমন বিগত সময়ের চেয়ে কমেছে। টেকনাফে বর্তমান ঘাট থেকে সমস্যা হলে সাবরাংয়ের জেটি দিয়ে জাহাজ চলাচল শুরু করা যায়। এখান থেকে জাহাজগুলো সেন্টমার্টিন ঘাটে পৌঁছানো অনেক সহজ, ভাড়াও বাড়বে না, সময়ও কম লাগবে।

সেন্টমার্টির দ্বীপের আবাসন ব্যবসায়ী মো. দিদারুল আলম বলেন, সেন্টমার্টিনের প্রায় ১০ হাজার মানুষের মধ্যে ৯০ শতাংশই পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত। বাকি ১০ শতাংশ মানুষের রুটিরুজি নির্ভর করে সাগরে মাছ ধরায় ?আর পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত ৯০ শতাংশ মানুষের আয় হয় মাত্র চার মাস। বছরের বাকি সময়টা তারা চার মাসের আয় দিয়ে চালায়। কিন্তু ভরা মৌসুমেও দ্বীপে আশানুরূপ সংখ্যক পর্যটক যেতে না পারায় আমাদের লগ্নি উঠে আসবে বলে মনে হয় না। আয় বন্ধ থাকায় পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে আমাদের। তাই অতি দ্রুত টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে জাহাজ চলাচলের অনুমতি দিতে সরকার ও প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।

কক্সবাজার হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হোটেল ওশান প্যারাডাইস লিমিটেডের পরিচালক আবদুল কাদের মিশু বলেন, অর্ধসহস্রাধিক হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউজ ও কটেজ মালিক ভরা মৌসুমেও পর্যটক না পেয়ে হতাশায় ভুগছেন। আমাদের শতকোটি টাকা ঋণ চলমান, ব্যবসা না পেলে ঋণের কিস্তি পরিশোধে হিমশিম খেতে হয়।

কক্সবাজারের নবাগত জেলা প্রশাসক (ডিসি) মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, পর্যটন সম্ভাবনাময় শিল্প। এর প্রসারে সরকার করণীয় সবকিছুই করছে। টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ নাব্য সংকটজনিত কারণে। বিকল্প প্রস্তাবনা নিয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন মহলে লিখেছি। এখানে নৌ-মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা আছে। আমাদের পাঠানো চিঠির বিষয়ে নির্দেশনা এলে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। 

 

ইত্তেফাক/ইআ