শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বড়দের অনাচারের শিকার হচ্ছে শিশুরা

আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০২২, ০৬:০৩

বড়দের বিবাদে প্রাণ যাচ্ছে কোমলমতি শিশুদের। শুধু দেশই নয়, বিভিন্ন কারণে বিশ্বব্যাপী এই প্রবণতা বাড়ছে। দুর্বল হয়ে পড়েছে মানুষের নৈতিক অবস্থা। আত্মঘাতী হয়ে উঠছে মানুষ। পরকীয়া, পারিবারিক কলহ, হত্যা, খুন এখন নিত্যদিনের ঘটনা। এসব ঘটনার কখনো সাক্ষী হচ্ছে শিশুরা, আবার কখনো প্রতিশোধের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে অবুঝ এই শিশুরাই। আবার অনেক ক্ষেত্রে সন্তানসহ আত্মহত্যা করছেন মা, কেউ বা প্রতিশোধ নিতে প্রতিপক্ষের শিশুকে হত্যা করছে। এসব বিবিধ ঘটনার নীরব শিকার হচ্ছে অবুঝ শিশুরা। কোনো কিছু না বুঝেই তাদের এ পৃথিবী থেকে চলে যেতে হচ্ছে বলে জানান বিজ্ঞজনেরা।

কিছু ঘটনা :সম্প্রতি ১৫ নভেম্বর নিখোঁজ হয় পাঁচ বছরের শিশুকন্যা আলিনা ইসলাম আয়াত। ১০ দিন পর পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন শিশুটিকে হত্যা করে ছয় টুকরো করে ফেলে দেওয়া হয়েছে। শিশুটিকে হত্যা করে প্রতিবেশী আবির আলী নামের এক ব্যক্তি। ২ ডিসেম্বর দিনাজপুরের খানসামা উপজেলায় আট বছর বয়সি শিশু আরিফুজ্জামানকে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে নিয়ে যায় প্রতিবেশী যুবক শরিফুল ইসলাম। এরপর শিশুর বাবার কাছে শরিফুল ১ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণ না পেয়ে রাতেই শিশুকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ বস্তাবন্দি অবস্থায় বাড়ির আঙিনায় পুঁতে রাখে। রাজধানীর হাজারীবাগের রায়েরবাজারে ৮ ডিসেম্বর একটি বাসায় হাসিনা বেগম (৩০) নামে এক মা তার তিন বছর ও ছয় মাস বয়সি দুই শিশু সন্তানকে হত্যা করে আত্মহত্যা করেন। তদন্তসংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, পারিবারিক কলহের জেরে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। চলতি বছরের ৩১ মে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে কীটনাশক পানে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন গৃহবধূ সোনিয়া আক্তার (২৬)। জানা যায়, পারিবারিক কলহের কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। ১৯ মার্চ পারিবারিক কলহের কারণে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন এক পিতা। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার জালকুড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ১৭ ফেব্রুয়ারি নওগাঁর রাণীনগর উপজেলায় পারিবারিক কলহের জেরে পাঁচ বছরের শিশু সন্তানসহ ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আরেক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেন। এ দুর্ঘটনার পেছনেও পারিবারিক কলহকে চিহ্নিত করা হয়।

পরিসংখ্যান :আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৪৩৯টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১০৪ জনের বয়স ছয় বছরের নিচে, ৭৯ জনের বয়স ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। ৯৭৫ জন শিশুর ওপর নানা ধরনের সহিংসতা হয়েছে। এগুলো শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের হিসাব। বাস্তবে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে ৭৪০ নারী ও শিশুকে অপহরণ করা হয়। জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এ ছয় মাসে মোট ৫০ শিশু অপহরণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে ৪৪ জনকে। বেশির ভাগ ভুক্তভোগী শারীরিক নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার। আর দুজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।     

বিজ্ঞজনেরা বলছেন, বাংলাদেশ শিশু অধিকার সনদে সই করেছে ১৯৮৯ সালে। কেটে গেছে দীর্ঘ ৩৩ বছর। কিন্তু নিরাপদ হয়নি শিশুর জন্যে এ সমাজ তথা রাষ্ট্র। আমাদের রাষ্ট্রের ব্যাপক অর্জন নিমেষে মিলিয়ে যায়, যখন শিশু-কিশোরদের জন্য একটি নিরাপদ সমাজ না থাকে। সব অর্জন ফিকে হয়ে যায়, যখন সমাজে নারী-শিশুরা নিরাপত্তাহীন থাকে। নৈতিক অবক্ষয়, পরকীয়া, সাইবার দুনিয়ার প্রতি নিয়ন্ত্রণহীন আসক্তি ও পারিবারিক বিশৃঙ্খল জীবনে শিশুরা বেশি ক্ষতির শিকার।

মানবাধিকারকর্মী ও চাইল্ড লেবার মনিটরিং সেলের কো-চেয়ার অ্যাডভোকেট সালমা আলী ইত্তেফাককে বলেন, আকাশ সংস্কৃতির কারণে ফেসবুক, টুইটার থেকে শুরু করে যেসব সাইট দেখা উচিত নয়, তাও দেখেছে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্করা। যে কারণে তারা অপরাধের নানা কৌশল রপ্ত করছে সহজে। তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, কিশোর উন্নয়নকেন্দ্রে দেখেছি, সেখানে কিশোর অপরাধীরা সংশোধন হওয়ার বদলে আরো অপরাধী হয়ে উঠছে। এই জায়গাগুলোতে কোনো কাজ হচ্ছে না। তিনি বলেন, সহজে হাতের কাছে মানুষ মাদক পাচ্ছে, ফলে বিবেক-বুদ্ধি কাজ করে না। রাজনৈকিত দলগুলোর ছত্রছায়ায় থেকে কিশোররা ক্ষমতার বলে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ফলে আমরা সমাজে কিশোর গ্যাং দেখছি। যারা সহজেই অপরাধী হয়ে উঠছে। সামান্য কারণে তারা শিশুদের নির্যাতন-হত্যা করছে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের বিরাট ভূমিকা আছে। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছু হচ্ছে না। এই বিষয়গুলো নিয়ে সমাজে আন্দোলন করতে হবে সোচ্চার হতে হবে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনিস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক ইত্তেফাককে বলেন, বাংলাদেশের শিশু নির্যাতনকে আমরা দুভাবে দেখি। একাটি—পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে নির্যাতন। শিশুরা যখন বড়দের কোনো ঘটনার সাক্ষী হয়ে যায়, তখন সেই সাক্ষী না রাখা কিংবা পরিবারের সদস্যদের অভ্যন্তরিণ কোন্দলের শিকার হন, এটি একটা চিত্র। অন্যটি হচ্ছে—পরিবারের বাইরে শিশু নির্যাতনের অনেকগুলো কারণ আছে সেই কারণগুলো আমরা একটা কারণের মধ্যে নিয়ে আসি। প্রতিশোধের লক্ষ্য হিসেবে শিশুরা নির্যাতন বা হত্যার শিকার হয়।

 

ইত্তেফাক/ইআ