মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ ২০২৩, ১৩ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

বিবিএসের জরিপ

দেশে প্রতিবন্ধীদের ৪৪ শতাংশ বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার

আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০২২, ০১:৩৬

দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ৪৩ দশমিক ৭০ শতাংশ বৈষম্যমূলক আচরণ, দুর্ব্যবহার ও নিগ্রহের শিকার। যারা বৈষম্য বা হয়রানির শিকার হয়েছেন, তাদের ৯০ দশমিক ৫৮ শতাংশ তাদেরই প্রতিবেশীদের দ্বারা এ ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। এছাড়া আত্মীয়স্বজন (৪৩.৩৩%), বন্ধু-বান্ধব (২৮.৪১%) এবং নিজ পরিবারের সদস্য (২৬.৯৭%) দ্বারাও এ ধরনের আচরণের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। 

‘জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ (এনএসপিডি) প্রতিবেদন ২০২১’ গতকাল মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। দেশে প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার প্রায় শতভাগ অর্জিত হয়েছে। কিন্তু প্রতিবন্ধী শিশুদের মধ্যে এ হার অর্ধেকেরও কম। প্রতিবন্ধী শিশুদের মাত্র ৩৪ দশমিক ৭১ শতাংশ প্রাথমিক স্তরে যেতে পেরেছে। শুধু তাই নয়, প্রাথমিকের গণ্ডি পেরনো এ প্রতিবন্ধী শিশুদের মাত্র ২৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছে। যাদের বয়স ৫ থেকে ২৪ বছরের বয়সি অর্থাৎ শিক্ষা গ্রহণে উপযোগী, তাদের মাত্র ৩২ দশমিক ৬০ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়েছে। 

জরিপে দেখা যায়, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা প্রতিবন্ধিতার কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তুলনায় দেরিতে লেখাপড়া শুরু করে। গড়ে প্রায় আড়াই বছর পিছিয়ে থাকে এ শিশুরা। দেশে প্রতিবন্ধীদের আর্থসামাজিক অবস্থা জানতে এ জরিপটি করা হয়েছে। জরিপের ফলাফল গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ উপলক্ষ্যে পরিসংখ্যান ভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন। বিবিএসের মহাপরিচালক মো. মতিয়ার রহমানের সভাপতিত্বে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামাল। এতে প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক উপস্থাপন করেন জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ প্রকল্পের পরিচালক ইফতেখাইরুল করিম।

জরিপের ফল অনুযায়ী সার্বিকভাবে দেশের ২ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ শারীরিক, মানসিক বা যে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার। গ্রামীণ এলাকায় এ হার ২ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলের ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের তুলনায় গ্রামীণ অঞ্চলে প্রতিবন্ধিতার হার বেশি। বিভাগভিত্তিক পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধী খুলনা বিভাগে ৩ দশমিক ৬২ শতাংশ। সবচেয়ে কম সিলেটে ২ দশমিক ১৫ শতাংশ। এছাড়া বরিশালে ২ দশমিক ৪২ শতাংশ, চট্টগ্রামে ২ দশমিক ৪১ শতাংশ, ঢাকায় ২ দশমিক ৫১ শতাংশ, ময়মনসিংহে ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। তবে ওয়াশিংটন গ্রুপ প্রতিবন্ধিতার পরিসংখ্যান মডিউল অনুযায়ী দেশে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৭ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। ‘ফাংশনাল ডিফিকালটি’র ভিত্তিতে এই হার পাওয়া গেছে। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সিদের মধ্যে এই হার সবচেয়ে বেশি ২২ দশমিক ৬০ শতাংশ।

এতে আরো দেখা যায়, প্রতিবন্ধীরা স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে অনেক পিছিয়ে আছে। ভাতার আওতায় আসেনি দেশের অর্ধেকের বেশি প্রতিবন্ধী। প্রকল্প পরিচালক ইফতেখাইরুল করিম বলেন, ইতিপূর্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ধারণাগত জরিপ পরিচালনা করলেও এবারই প্রথম প্রতিবন্ধীদের আর্থসামাজিক অবস্থা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ জরিপ করা হলো। দেশের আটটি বিভাগের ৩৬ হাজার পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করে এ জরিপটি করা হয়েছে। পরিবারগুলোর আর্থসামাজিক অবস্থা ছাড়াও প্রতিবন্ধিতার ধরন, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ, ভাতা গ্রহীতা, শিক্ষার অবস্থা, কর্মসংস্থান প্রভৃতি বিষয় উঠে এসেছে। প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকার বিভিন্ন সময়ে সহাযোগিতা ছাড়াও নীতিনির্ধারণে এ জরিপটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করেন।

জরিপে দেখা যায়, দেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ কর্মসংস্থানে রয়েছেন। পুরুষদের মধ্যে এ হার ৪৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং নারী প্রতিবন্ধীদের মধ্যে ১২ দশমিক ৮০ শতাংশ।

শিক্ষার সুযোগ বাড়িয়ে প্রতিবন্ধীদের জনশক্তিতে রূপান্তর করে তাদের অর্থনীতির মূল ধারায় নিয়ে আসার তাগিদ দিয়েছেন অনুষ্ঠানের বক্তারা। তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বৃদ্ধি ও চিকিৎসার সুযোগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন তারা। বিবিএসের জরিপ প্রতিবেদনে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩’ এ উল্লেখিত বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধিতার হার উল্লেখ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, অটিজমের হার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ, শারীরিক প্রতিবন্ধী ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ, মানসিক প্রতিবন্ধিতার হার শূন্য দশমিক ২৯ শতাংশ, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ, বাক্প্রতিবন্ধী শূন্য দশমিক ৩২ শতাংশ, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শূন্য দশমিক ২২ শতাংশ, শ্রবণপ্রতিবন্ধী শূন্য দশমিক ৩৬ শতাংশ, সেরিব্রাল পালসি (অপরিণত মস্তিষ্কে কোনো আঘাত বা রোগের আক্রমণের কারণে শারীরিক বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা) শূন্য দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, ডাউন সিনড্রোম (মৃদু থেকে গুরুতর বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা) শূন্য দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, শ্রবণ-দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা শূন্য দশমিক ২ শতাংশ, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা হার শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ।

প্রতিবন্ধিতার কারণ :জরিপ অনুযায়ী জন্মগত সমস্যার কারণে প্রতিবন্ধী হয়েছে ৪১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, অসুস্থতার কারণে ৩৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ছাদ বা গাছ থেকে পড়ে যাওয়া ১২ দশমিক ২৭ শতাংশ, সড়ক দুর্ঘটনায় সাড়ে ৫ শতাংশ, আগুন দুর্ঘটনায় ১ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ, রেল দুর্ঘটনায় শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী হয়েছে।

 

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন