শুক্রবার, ২৪ মার্চ ২০২৩, ১০ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

পদ্মাসেতুর উদ্বোধনের মাইলফলক আর মেট্রোর যুগে বাংলাদেশ

আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২২, ১৮:০২

২০২২ সালে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প উদ্বোধনের মাধ্যমে নতুন যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে পদ্মাসেতু উদ্বোধন মাইলফলক হয়ে থাকবে। এছাড়া বছরের শেষে এসে মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। বেশ কয়েকটি বড় বড় প্রকল্প উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে।  

দেশের অর্থনীতিকে জোরদার করার লক্ষ্যেই শুরু হয়েছিল একাধিক মেগা প্রকল্প। সেসব যুগান্তকারী মেগা প্রকল্পের বেশিরভাগই শেষ হয়েছে ২০২২ সালে। সেজন্যই বলা হচ্ছে, ২০২২ সাল যেন মেগা প্রকল্প উদ্বোধনের বছর।

পদ্মাসেতু


বর্তমান সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকারভুক্ত (ফার্স্ট ট্র্যাক) ১০ প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল পদ্মা সেতু। ইতোমধ্যে উদ্বোধনের পর এই সেতু দিয়ে চলছে যানবাহন। পাশাপাশি পদ্মা সেতুর রেলসংযোগের কাজ এগিয়ে চলছে পুরোদমে। আগামী বছরের জুনে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার রেললাইন চালুর লক্ষ্যে কাজ চলছে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ছিল মেগা প্রকল্পগুলো উদ্বোধনের মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ।

পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণে বসবাসরত জনজীবনের জীবনমান উন্নয়নসহ স্বল্প সময়ে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত ও বাজার সম্প্রসারিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। এ অঞ্চলের উৎপাদিত কাঁচামাল দ্রুততার সঙ্গে সরবরাহের সুযোগ তৈরি ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে এই পদ্মা সেতু। ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন রয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণ এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহজ হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় তিন কোটি মানুষ উপকৃত হচ্ছে।

পায়রা সমুদ্রবন্দর


২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টিয়াখালী ইউনিয়নের ইটবাড়িয়া গ্রামে এর ভিত্তিফলক উন্মোচন করেন। কিন্তু ২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রা সমুদ্রবন্দরে বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে বন্দরের ক্যাপিটাল ড্রেজিং, আটটি জাহাজের উদ্বোধন, প্রথম টার্মিনাল, ছয় লেনের সংযোগ সড়ক ও একটি সেতু নির্মাণ। সমুদ্রবন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ে ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১০০ থেকে ১২৫ মিটার চওড়া এবং ১০ দশমিক ৫ মিটার গভীর চ্যানেল তৈরি হবে। যা বন্দরে ৪০ হাজার টন কার্গো বা ৩ হাজার কনটেইনারবোঝাই জাহাজ ডক করার সক্ষমতা তৈরি করবে।

ক্যাপিটাল ড্রেজিং চ্যানেলে আনুমানিক ৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা খরচ হবে। বেলজিয়ামভিত্তিক ড্রেজিং কোম্পানি জান ডি নুল ড্রেজিংয়ের কাজ করবে। ২০৯ দশমিক ৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত জাহাজ ও নৌযানগুলো বন্দর কর্তৃপক্ষকে বিদেশি জাহাজের আগমন-গমন পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণে সহায়তা করবে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বন্দরটিকে তার পূর্ণ সক্ষমতায় কাজ করতে সক্ষম করবে। প্রকল্পগুলো দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যোগ করবে। যার সুফল জাতি যুগ যুগ ধরে ভোগ করবে।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি ৬ সেপ্টেম্বর খুলনার রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাচালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মৈত্রী পাওয়ার প্ল্যান্টের ইউনিট-১ যৌথভাবে উদ্বোধন করেছেন। কনসেশনাল ফাইন্যান্সিং স্কিমের অধীনে ভারতীয় উন্নয়ন সহায়তা হিসাবে ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারসহ প্রায় দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপন করা হচ্ছে। ভার্চুয়ালি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উদ্বোধনের আগে দুই প্রধানমন্ত্রী ভারতের হায়দ্রাবাদ হাউজে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পর ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে স্বাক্ষরিত সাতটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) বিনিময় প্রত্যক্ষ করেন।

মেট্রোরেল


ঢাকা মহানগরীর মানুষকে সহজে যাতায়াত সুবিধা দিতে সরকারের একটি মেগা প্রকল্প হলো মেট্রোরেল। ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় ছয়টি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এই ছয়টির আওতায় মোট ১২৮ দশমিক ৭৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল নির্মাণ করা হবে। তার মধ্যে উড়াল ৬৭ দশমিক ৫৬৯ কিলোমিটার এবং পাতাল ৬১ দশমিক ১৭২ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণ করা হবে। ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) নামে একটি সংস্থা গঠন করেছে সরকার। লাইনগুলোর মধ্যে উত্তরা থেকে মতিঝিল এমআরটি লাইন-৬ এর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আর বাকিগুলো এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এমআরটি লাইন-৬ উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল হয়ে কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত হচ্ছে।

২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এই মেট্রোরেল প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৩১ মে পর্যন্ত ৮০.১০ শতাংশ। এমআরটি-৬ এর অধীনে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১.১৬ কিলোমিটার বর্ধিত করার জন্য ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ইতোমধ্যে উত্তরা-আগারগাঁও লাইনে ট্রেনের ট্রায়ালও হয়েছে। মেট্রোরেল ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। ২৮ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে মেট্রোরেল প্রকল্পটি চালু হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটির উদ্বোধন করেন এবং টিকেট কেটে প্রথম যাত্রী হিসেবে মেট্রোরেলে চড়েন। প্রাথমিকভাবে উত্তরা দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাও পর্যন্ত মেট্রোরেল সেবা চালু রয়েছে। আস্তে আস্তে অন্যান্য স্টেশনেও যাত্রীসেবা চালু করা হবে। সকাল ৯ টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু থাকবে। প্রথমদিনেই মেট্রোরেলে প্রায় ৪ হাজার যাত্রী চড়েছেন।

কর্ণফুলী টানেলের কার্যক্রম উদ্বোধন


২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের বোরিং কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণে ব্যয় হবে ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা, যার মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ সহায়তা তিন হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা এবং চীন সরকারের অর্থ সহায়তা পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা।

দুই টিউবের মূল টানেলটির দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার। এর সঙ্গে টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক এবং ৭২৭ মিটার ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হবে। ওয়ান সিটি টু টাউন মডেলে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কে সংযুক্তির উদ্দেশে এ টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম শহরকে বাইপাস করে সরাসরি কক্সবাজারের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ স্থাপিত হবে। ফলে চট্টগ্রাম শহরের যানজট কমে আসবে। প্রকল্পটির সার্বিক অগ্রগতি ৩২ শতাংশ  এবং ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে প্রাক্কলন করা হলেও নানা কারণে তা চালু হওয়ার সময় পেছানো হয়েছে।

এখনো পুরোদমে চালু আছে বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্প। তারমধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে দিনকে দিন নানা সমালোচনা বেড়েই চলেছে। তবু নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে উচ্চাভিলাষী মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। সামনে বাকিগুলোও বাস্তবায়িত হয়ে যাবে ২০২৩ সালে এমন আশাই করছেন অনেকে।

ইত্তেফাক/এআই