ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের সমন্বিত গেটের নিরাপত্তা প্রহরী ছিলেন মো. দুলাল মিয়া। হলের সাধারণ ছাত্রীদের কাছে তিনি পরিচিত বংশিবাদক দুলাল ভাই কিংবা দুলাল মামা নামে। গভীর রাতে হল গেটে বসে বাঁজানো বাঁশির সুরে আপ্লুত হতেন ছাত্রীরা। অনেক ছাত্রীই তার কাছে আসতো বাঁশির সুর শুনতে। সেই দুলাল মিয়া পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন গত মঙ্গলবার।
কিছুদিন আগে তিনি চিকিৎসা নিতে হাসপাতাল যান, কিন্তু সেখান থেকে এসে কাউকে কিছু বলেননি বলে জানান বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের প্রিন্সিপ্যাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার মো. আলমগীর আলম। মঙ্গলবার (৩ জানুয়ারি) ভোর ৬টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। এখন আর বাঁশি বাজানোর কেউ থাকলো না মৈত্রী-বঙ্গমাতা হলে।
এদিকে, দুলালের মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শোক প্রকাশ এবং স্মৃতিচারণমূলক স্ট্যাটাস দিয়েছেন হলের সাবেক-বর্তমান অনেক ছাত্রীই। স্মৃতিচারণ করে শিক্ষার্থী সুপ্তি দাস চৈতি লিখেন, ‘আমার হল লাইফের ৯০ ভাগ রাত কেটেছে ছাদে জেগে। তাই দুলাল ভাইয়ের বাঁশি শুনতাম মুগ্ধ হয়ে। এমনকি বগুড়া, বরগুনা থেকে গবেষণার কাজ শেষে রাতে হলের ফিরে হল গেটে এসে দেখেছি দুলাল ভাই বাঁশি বাজানো থামিয়ে দারুণ এক হাসিমুখ নিয়ে গেট খুলে দিচ্ছেন। আমি নাই ওইখানে, আজ থেকে দুলাল ভাইও নাই। দুলাল ভাই অন্য দুনিয়াতে চলে গেলেন।’
নুরে আঞ্জুম নামে এক ছাত্রী লিখেন, ‘হলে আসার পর প্রায়ই শুনতাম কেউ খুব দরদ মিশিয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে। পরে জানতে পারলাম আমাদের হলের নিরাপত্তা প্রহরী দুলাল মিয়া এই বাঁশি বাজান। এইতো গত ২৮ তারিখ রাতে পরদিনের সেমিস্টার ফাইনালের পড়া পড়তে পড়তে যখন মাথা ধরে গিয়েছিলো, হলের করিডোরে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম তার বাঁশি। আজ পরীক্ষা দিয়ে হলে ফেরার সময় দেখলাম... মো. দুলাল মিয়ার মৃত্যুতে আমরা শোকাহত।’
ব্যক্তিগত জীবনে বিয়ে করেননি দুলাল মিয়া। পরিবার বলতে মা-বাবা ও বোনকে নিয়ে সংসার চলতো দুলাল মিয়ার। কেন বিয়ে করেননি তার কারণ কেউ না জানলেও হল দুইটির ছাত্রীরা জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো এক ছাত্রীকে পছন্দ ছিল দুলাল মিয়ার। ওই ছাত্রী হল ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বিরহে আর বিয়ে করেননি। তিনি প্রায়ই বলতেন, মামা, এই দুনিয়াতে আপনার দিকে কেউ তাকাবে না। নিজের আত্মার প্রশান্তিকে গুরুত্ব দেন, নিজেকে গুরুত্ব দিন। আপনি যারে ভাবতে ভাবতে আপনার দিন গুজরান করে দিচ্ছেন সে হয়তো আপনাকে কোনোদিন খেয়ালই করেনি।
দুই হলের ছাত্রীরা জানান, হল এলাকায় বাঁশি বাজানোর কারণে কয়েক বছর আগে দুলাল মিয়াকে শোকজ করে হল প্রশাসন। দুলাল মিয়ার বাঁশির সুরে ছাত্রীরা লনে বসে কান্না করতো, তাই হল প্রশাসন এ শোকজ করে। এর পর থেকে হল এলাকায় খুব বেশি বাঁশি বাজাতে দেখা যায়নি দুলাল মিয়াকে। কেউ একটু অনুরোধ করলে, আস্তে আস্তে বাঁশি বাজিয়ে শোনাতেন।
হলের সামনে আড্ডা দিতে যান ছাত্ররাও। ছাত্রদের একজন জোবায়ের আলম বলেন, কতগুলো রাত কেটেছিল দুলাল মামার বাঁশির মোহে, সেই সন্ধ্যায় বসতাম, কখনো রাত ১০টা নাগাদ উঠতাম, সূরের মূর্চনায় দুলাল মামা মন উদাস করে দিতেন। হঠাৎ শুনলাম, দুলাল মামা নেই আর। দুলাল মামা যেখানেই থাকুন, শান্তিতে থাকুন।