রোববার, ০১ অক্টোবর ২০২৩, ১৬ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

চাতালে রয়ে গেছে কৃতদাস প্রথা!

চুক্তির ফাঁদে নির্যাতনের শিকার নারী শ্রমিকরা

আপডেট : ০৯ জানুয়ারি ২০২৩, ০৪:০১

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের সোহাগপুর এলাকার জোহরা-সুরুজ চাতাল মিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন পায়েল ও জেসমিন। ভালোবেসে বিয়ে করে দুই পরিবারের কারোরই সহযোগিতা না পেয়ে একপ্রকার খেয়ে-না খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে তাদের। পেটের ক্ষুধা মেটাতে তারা শ্রমিক সর্দার কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার মো. রফিকুল ইসলামের (রবিউল) সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক কাজে যোগ দেন একটি চাতালে। তবে অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি, বরং খাটুনি বেড়েছিল কয়েক গুণ। জেসমিনের অভিযোগ, একপর্যায়ে জেসমিনকে শ্রমিক সর্দার কুপ্রস্তাব দেন। পরবর্তী সময়ে সুযোগ পেলেই তিনি তার শ্লীলতাহানি করেন, সেই সঙ্গে চলছিল মানসিক নির্যাতনও। পরে গর্ভবতী হলে স্বামীকে রেখেই জেসমিন বাবা-মায়ের কাছে আশ্রয় নেন। এতে শ্রমিক সর্দার ক্ষিপ্ত হন এবং দাদনের টাকা না দিয়ে পালানোর মিথ্যা মামলা করেন জেসমিন, তার বাবা-মা, বোন, স্বামী পায়েলসহ আট জনের বিরুদ্ধে।

শুধু জেসমিন-পায়েল নন, দিনের পর দিন চাতালে চুক্তিভিত্তিক নারী শ্রমিকেরা এমন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। সম্প্রতি কিশোরগঞ্জ ও আশুগঞ্জে গিয়ে দেখা যায় এমন ‘নব্য ক্রীতদাসীদের’।

মামলার বাদী শ্রমিক সর্দার রফিকুল ইসলাম মোবাইল ফোনে বলেন, ‘আমি আট জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছি, যারা সবাই পালিয়েছে। তাদের কেউই আমার পাওনা টাকা পরিশোধ করেনি। শ্রমিকদের টাকা দেওয়ার কোনো প্রমাণ আছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজে শ্রমিক জয়েন করলেই আমরা দাদনের টাকা দিয়ে দেই। লিখিত কিছু থাকে না।’ যৌন হয়রানির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এসব কথা মিথ্যা। চাতালে কোনো শ্রমিকের দিকে আড়চোখে তাকানোরও সুযোগ নেই।’ জেসমিনের বাবা আব্দুল কাদির ও বোন আকলিমাকে চেনেন কি না—এমন প্রশ্নে জোহরা সুরুজ চাতালের ম্যানেজার মো. মামুন খান বলেন, এই নামে এই চাতালে কোনো শ্রমিক ছিলেন না। তবে রফিকুল একজন চরিত্রহীন এবং বর্তমানে রফিকুল পলাতক বলে তিনি জানান। এই ভুক্তভোগী শ্রমিকদের আইনি সহায়তা দেন বেসরকারি সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)-এর ডেপুটি ম্যানেজার (আইন) অ্যাডভোকেট এ কে এম বুলবুল আহমেদ। জেসমিনদের বিরুদ্ধে মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কেউ অভিযোগ করতেই পারে। তবে এই মামলার শক্ত কোনো ভিত্তি নেই। তারা যে টাকা নিয়েছে, লিখিত কোনো প্রমাণও নেই। এ ছাড়া, শ্রমিক না হয়েও জেসমিনের বাবা ও বোনকে আসামি করা হয়েছে। ১৫ দিন জেল খাটানো হয়েছে। এতেই বোঝা যায় যে সম্পূর্ণ হয়রানিমূলকভাবে তাদের জড়ানো হয়েছে।’

যা হয় চাতালগুলোতে : শ্রমিক সর্দার রফিকুলের কথার সঙ্গে শ্রমিকদের কথার মিল পাওয়া যায় না। শ্রমিকেরা বলেন, ধানের মৌসুমে অনেক ভালো পারিশ্রমিক দেওয়ার কথা বলে এখানে আনা হয় তাদের। আনার পর তাদের আর বাইরে যেতে দেওয়া হয় না। কাজ করতে এসে দালালের কথায় ও কাজে কোনো মিল পাওয়া যায় না। এমনকি তাদের পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে দেওয়া হয় না। মোবাইল ফোনে সর্দারের সঙ্গে কালেভদ্রে কথা বলার সুযোগ হয়। সূর্য ওঠা থেকে সূর্য ডোবা পর্যন্ত ধান শুকানোর কাজ করেন তারা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেও নারী শ্রমিকেরা নিয়মিত পারিশ্রমিক পান না। তিন থেকে পাঁচ দিন বাদে দুই থেকে তনি কেজি চাল পান। ২৫ টাকা দরে এক কেজি চাল বিক্রি করে ডাল, লবণ কিনলেও কোনো দিন ভালো খাবার জোটে না তাদের কপালে। উপরন্তু সর্দারের যৌন হয়রানির সমস্যা তো আছেই।

নিয়মিত পালানো আর মামলা : জেসমিন ও পায়েলের পালানোর পরে যৌন হয়রানির শিকার আরো এক নারী শ্রমিক পালিয়ে যান। তখনই রফিকুল অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ দিয়ে জেসমিন, পায়েলসহ আট জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সরেজমিন জোহরা-সুরজ চাতালে গেলে রফিকুলের যৌন হয়রানির আরো অনেক অভিযোগ পাওয়া যায়। রফিকুলকে চরিত্রহীন ও লম্পট দাবি করে তার কঠিন শাস্তির দাবি করেন এই চাতালে কর্মরত নারী শ্রমিকেরা।

নির্যাতন থেকে বাদ পড়েনি নবজাতকও : ‘দাদন’ না নিয়েও গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন সদ্য সন্তান জন্মদানকারী মা জেসমিন। এমনকি সেই মামলায় নাম থাকায় এখনো পর্যন্ত সন্তানের মুখ দেখতে পাননি জেসমিনের স্বামী পায়েল মিয়াও। জন্মের ২০ দিন পরও সন্তান কাঁদেনি বলে জানালেন জেসমিন। গর্ভবতী অবস্থায় নির্যাতনের প্রভাবও হতে পারে এর কারণ। মামলার অন্য আসামি জেসমিনের বাবা, মা ও বড় বোন এই চাতাল সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা ‘দাদন’ নেওয়া এবং তা পরিশোধ না করার অভিযোগে মামলা হয়। এদিকে পুলিশ মামলা তদন্ত করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দায়ের করে। আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে গত ১৮ ডিসেম্বর রাতে জেসমিনের বাবা কাদির ও বড় মেয়ে আকলিমাকে গ্রেফতার করা হয়। জেসমিনের মা মিনা বেগম বলেন, ‘আমার বড় মেয়ে আর আমার স্বামী কী অপরাধ করেছে যে তাদের আসামি করল? সর্দারের কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় আমাদের এমন পরিণতি। তিনি এই মামলা থেকে পরিবারের মুক্তি চান।

 

ইত্তেফাক/ইআ