কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার দারোরা ইউনিয়নের পালাসুতা গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে এসে জামাতা ইসমাইল ও তার বন্ধ নূরু মিয়াকে ডাকাত বলে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে আপন চাচা ও প্রতিবেশী এক মাদক কারবারির বিরুদ্ধে। এ সময় গুরুতর আহত হয়েছেন জামাতার আরও এক বন্ধু। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের চারদিন পেরিয়ে গেলেও রহস্যজনক কারণে এখনো মামলা না হওয়ায় সাধারণ মানুষদের মঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
নিহত দুই যুবকের পরিবারের দাবি, তারা ডাকাত নয়, পরিকল্পিতভাবে তাদের গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবি করেন পরিবারের সদস্যরা।
পিটুনিতে নিহতরা হলেন, উপজেলার কাজিয়াতল গ্রামের আব্দুস ছালামের ছেলে (জামাতা) নুরু মিয়া (২৮) ও তার বন্ধু একই উপজেলার পালাসুতা গ্রামের মৃত গিয়াস উদ্দিনের ছেলে ইসমাইল হোসেন (২৭)। অপর আহত বন্ধু শাহজাহান (২৮) সদর দক্ষিণ থানার বাগমারা গ্রামের সেলিম মিয়ার ছেলে মুমূর্ষ অবস্থায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
সরেজমিনে অনুসন্ধান করে জানা যায়, গত শুক্রবার রাতে বোড়ারচর গ্রামে ডাকাতি করতে এসে ৩ জন পালাসুতা গ্রামের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে- এমন খবর এলাকার মাইকে ঘোষণা করা হয়। পরে আশপাশের কয়েক গ্রামের সহস্রাধিক লোক জড়ো হয়ে ডাকাত সন্দেহে নাবু মিয়ার ঘর থেকে তার মেয়ের স্বামীসহ দুই বন্ধুকে ঘর থেকে ধরে এনে গণপিটুনি দেয়। এতে তিনজনই গুরুতর আহত হন। খবর পেয়ে মুরাদনগর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে তাদের উদ্ধার করে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুইজনের মৃত্যু হয়।
পিটুনিতে আহত শাহজাহান বলেন, ঘটনার দিন নূরুর শশুরবাড়িতে থাকা ছেলেকে দেখতে আমরা পালাসুতা গ্রামে যাই। রাত ১০টার দিকে নূরুর শ্বশুরবাড়িতে যাই। ঘরে বসে সকলের সাথে কথা বলছিলাম। ঠিক তখনই কিছু লোক এসে আমাদের ডাকাত বলে ঘর থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে ডাকাত বলে মারতে থাকে। আমি এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের দাবি করি।
নিহত নূরু মিয়ার মা জাহানারা বেগম ও স্ত্রীর বোন রফিয়া অভিযোগ করে জানান, নূরু কুমিল্লায় পরিবার নিয়ে থাকে। শুক্রবার রাতে সে তার দুই বন্ধুকি নিয়ে মাহফিলের কারণে রাত ৯টার দিকে গ্রামের বাড়িতে আসে। মায়ের সাথে দেখা করে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা বলে চলে যায় এবং সাড়ে ৯টার দিকে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে মোবাইলফোনে তার শ্বশুর ও শাশুড়ির সাথে কথা বলায়।
তারা বলেন, নূরু খারাপ কোন কাজের সাথে জড়িত নয়। তার বিরুদ্ধে এর আগে পুলিশি কোনো অভিযোগও নেই। তাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
নিহত ইসমাইলের স্ত্রী তানিয়া ও মা মিনোয়ারা বেগম অভিযোগ করে বলেন, আমাদের পরিবারের সাথে ইসমাইলের চাচার সিরাজুল ইসলাম শেখ সাহেবের জমিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আগে থেকে বিরোধ ছিলো। আমাদের বাড়ির প্রতিবেশী আলাউদ্দিন একজন মাদক কারবারি। আমরা যখন তাদের বাড়ির পাশে বাড়ি করি, তখন থেকে তারা আমাদের হুমকি দিতো এখান থেকে চলে যেতে। কারণ হিসেবে তারা জানায়, আমাদের জন্য তাদের মাদক বিক্রি করা সমস্যা হাচ্ছলো।
তারা বলেন, এ ঘটনার আগে থেকে শেখ সাহেবের স্ত্রী আমাদের বাড়িতে না আসলেও আলাউদ্দিনের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন। ঘটনার সময় শেখ সাহেব, তার ছেলে, আলাউদ্দিন ও তার স্ত্রী উপস্থিত থেকে নেতৃত্ব দেয়। মেরে ফেলার নির্দেশ দেয়।
অভিযুক্ত সিরাজুল ইসলাম শেখ সাহেব আগে থেকে চলা বিরোধ ও ঘটনাস্থলে থাকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, মানুষের মুখে ডাকাত আটক করা হয়েছে শুনে ঘটনাস্থলে যাই। কিন্তু তাদের হত্যার সাথে আমি ও আমার ছেলে জড়িত থাকার বিষয়টি মিথ্যা।
তিনি আরও বলেন, আলাউদ্দিন একজন মাদক কারবারি। আমার ভাই (ইসমাইলের বাবা) যখন আলাউদ্দিনের বাড়ির পাশে জমি কেনে, বাড়ি করে, তখনই বাড়ি না করতে আলাউদ্দিনর হুমকি দিচ্ছিলো। আলাউদ্দিনের সাথে আমার ভাইয়ের পরিবারদের তখন থেকেই বিরোধ চলছে।
অপর অভিযুক্ত আলাউদ্দিন বলেন, মারধরের ঘটনার সময় ঘটনারস্থলে আমি ছিলাম না। পুলিশ আসার পর ঘটনাস্থলে আমি ও আমার স্ত্রী যাই। এখন পূর্ব শত্রুতার জের ধরে ও এলাকাবাসীর ইন্ধনে আমার নাম জড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আমিও চাই এ ঘটনার সাথে যারা জড়িত, সবার শাস্তি হোক।
এ বিষয়ে মুরাদনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুজ্জামান তালুকদার বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। আজ কালকের মধ্যে ভিকটিমের পরিবার থানায় এসে মামলা করবে। পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ পুলিশের সকল টিম কাজ করছে। তদন্ত করে অভিযুক্ত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।