ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণায় চুরি ঠেকাতে করা হচ্ছে নীতিমালা। একই সঙ্গে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে হলে পিএইচডি ডিগ্রি বাধ্যতামূলক করার নিয়ম পাশ হবে। আজ মঙ্গলবার বেলা ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনের একাডেমিক কাউন্সিলের এই সভা অনুষ্ঠিত হবে। এই নিয়ম পাশ হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকগণ গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি করলে তার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে নির্ধারিত শাস্তির মুখোমুখি হবেন। এর আগে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির জন্য নির্ধারিত কোনো শাস্তি ছিল না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের এবারের একাডেমিক কাউন্সিলের প্রধান এজেন্ডা চৌর্যবৃত্তিবিষয়ক নীতিমালা ‘দ্য রুলস ফর দ্য প্রিভেনশন অব প্ল্যাজারিজম’ শীর্ষক নীতিমালা নিয়ে আলোচনা এবং একাডেমিক কাউন্সিলে এর অনুমোদন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অধ্যাপক পদে পদোন্নতি নেওয়ার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি বাধ্যতামূলক করা। এ দুই নীতিমালা অনুমোদন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা খাতে ব্যাপক পরিবর্তন হবে বলে মনে করছেন তারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত নীতিমালায় ২০ শতাংশ পর্যন্ত কোনো শাস্তি রাখা হয়নি। ২০ শতাংশের ওপর থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত অপরাধ ‘লেভেল-১’ হিসেবে গণ্য হবে। এর প্রমাণ মিললে সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি বা ক্রেডিট ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে ঐ সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট পাণ্ডুলিপি সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তিকে থিসিস সংশোধনের সুযোগ সাপেক্ষে নির্দিষ্ট পরিমাণ জরিমানা করা হবে। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি বা কোর্স বাতিল বা প্রত্যাহারের বিধান রাখা হয়েছে।
গবেষণায় ‘লেভেল-২’-এর আওতায় পড়বে ৪০-এর ওপর থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত। এক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তি আর্থিক জরিমানা সাপেক্ষে নকলকৃত পাণ্ডুলিপি সংশোধনের জন্য সর্বোচ্চ দেড় বছর পর্যন্ত সময় পাবেন। ঐ সময় সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি বা ক্রেডিট স্থগিত থাকবে। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংশোধনে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি বা কোর্সটি বাতিল হয়ে যাবে। লেভেল-২-এ দায়ী ব্যক্তি যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা কিংবা গবেষক হন এবং তিনি যদি নকলকৃত ডিগ্রির ভিত্তিতে নিয়োগ, পদোন্নতি বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন, তাহলে সংশ্লিষ্ট সময়ে পাওয়া সমুদয় অর্থ অনতিবিলম্বে কোষাগারে ফেরত নেওয়া হবে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি বাতিলের পাশাপাশি এক ধাপ পদাবনতি ও চার বছরের জন্য পদোন্নতি বন্ধের শাস্তির মুখে পড়বেন দায়ী ব্যক্তি।
৬১ শতাংশের ওপরে সামঞ্জস্যকে উচ্চ ধাপ বা লেভেল-৩-এ রাখা হয়েছে। এই মাত্রার সামঞ্জস্যের প্রমাণ মিললে সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি বা কোর্স দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হতে পারে। দায়ী ব্যক্তি ঐ সময়ের মধ্যে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা সাপেক্ষে পাণ্ডুলিপি সংশোধনের সুযোগ পাবেন। এতেও ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ডিগ্রিটি বাতিল ও কোর্স অনুত্তীর্ণ (এফ গ্রেড) হিসেবে গণ্য হবে। কোনো অভিযুক্ত লেভেল-৩ পর্যায়ের অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটালে তার চাকরিচ্যুতির বিধান রাখা হয়েছে। আবার সব পর্যায়ের প্ল্যাজারিজমের ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট প্রকাশনা প্রত্যাহারের বিধান রাখা হয়েছে। এমনকি অভিযুক্তের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি বা কোর্সের সুপারভাইজার, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব জার্নালের ক্ষেত্রে এডিটোরিয়াল বোর্ডের সদস্যদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে নীতিমালায়।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশ বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি ঠেকানোর জন্য নীতিমালাটি প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু বাধ্যতামূলক পিএইচডির বিষয়টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের সঙ্গে সামজ্ঞস্যপূর্ণ নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি টিচিং ইউনিভার্সিটি হিসেবে। টিচিং ইউনিভার্সিটি হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি দেশের জন্য আদর্শের জন্ম দিয়েছে। একটি জাতিকে সুচারুরূপে গঠনের দায়িত্বভার ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দর্শনকে অস্বীকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সামজ্ঞস্যপূর্ণ নীতিমালা সংযোজন একটি ভুল প্রক্রিয়া।
তারা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশ্ববিদ্যালয় পুরো উপমহাদেশে একটিও নেই। সেখানে এখানকার নিয়ম-নীতি, এখানকার ছাত্র-শিক্ষক অন্য ৮-১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হবে না। এখানকার জন্য এখানকার নিজস্ব নিয়ম প্রণয়ন করা উচিত ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, নীতিমালাটি একাডেমিক কাউন্সিলে উত্থাপন করা হবে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এ বিষয়ে মতামত দেওয়ার সুযোগ পাবেন। তাদের যৌক্তিক মতামতের আলোকে নীতিমালায় সংশোধনী আনার সুযোগ রয়েছে। পরবর্তী সময়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সিন্ডিকেট সভায় উত্থাপন করা হবে।