শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ময়না পাখির লোভ দেখিয়ে অপহরণ-হত্যা: ২ খুনির খালাসের রায় স্থগিত

আপডেট : ২৪ জানুয়ারি ২০২৩, ২২:১৪

একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে ছিলেন দিশেহারা। সন্তুষ্ট ছিলেন চার আসামির ফাঁসির রায়ে। সেই চার আসামির দু’জন খালাস পান আপিলের রায়ে। যারা খালাস পান সেই খুনির একজনকে ঘর করে দেওয়াসহ নানাভাবে সহায়তা করেন নিহতের বাবা বাবু। খুনিরা খালাস পাওয়ার পর চিন্তিত ছিলেন তিনি। ইতিপূর্বে কারাগার থেকে স্বজনদের মাধ্যমে হুমকি দিয়েছিলেন বের হতে পারলে হত্যা করা হবে শিশুটির বাবাকে। ছুটে এসেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে। খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেয় রাষ্ট্রপক্ষ। খালাসের রায় স্থগিত চেয়ে চেম্বার আদালতে আবেদন দেয় অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়। সরকারি আইন কর্মকর্তার বক্তব্য শুনে খালাসের রায় স্থগিতের সিদ্ধান্ত দেন আপিল বিভাগের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম। আটকে যায় মুক্তির অপেক্ষায় থাকা দুই খুনির খালাসের রায়।

খালাসের রায় স্থগিত হয়েছে শুনে স্বস্তি পেয়েছেন নিহত শিশুর পিতা। চেম্বার আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইন কর্মকর্তা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পীকে তিনি বলেন, ‘স্যার, খুনি দুলালই মূল কালপ্রিট। সেই তার স্বজনদের মাধ্যমে জেলখানা থেকে আমাকে বার বার হুমকি দিয়েছে। বলেছে, কারাগার বের হতে পারলে আমাকে আগে খুন করবে। যখন তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে তখন থেকেই আমি ভয়ের মধ্যে ছিলাম।

এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের ওই কৌসুলি তাকে অভয় দিয়ে বলেন, ‘ভয় নেই। খালাসের রায় স্থগিত হয়েছে। এখন হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করব।

এদিকে রায় স্থগিতের এই আদেশ দ্রুত ফ্যাক্সযোগে গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি সেলের জেল সুপার সুব্রত কুমার বালাকে পাঠানো হয়। এর আগে হাইকোর্টের ডেসপাস শাখা থেকে দুই আসামির খালাসের আদেশ পরদিনই কারাগারে পৌঁছে যায় দ্রুততার সঙ্গে। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ায় মুক্তি আটকে যায় দুই খুনির। হাফ ছেড়ে বাঁচেন মামলার বাদী ও তার পরিবারের সদস্যরা।’

মামলার বিবরণে জানা যায়, শাকিবুল হাসান টুটুল ছিলেন কিন্ডারগার্টেনের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। ২০১৪ সালের ১২আগস্ট স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে তাকে অপহরণ করা হয়। ‘ময়না পাখির বাচ্চা’ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তাকে স্কুল থেকে অপহরণ করে আসামিরা। টেলিফোনে শিশুটির বাবা-মায়ের কাছে মুক্তিপণ হিসাবে দাবি করা হয় দশ লাখ টাকা। ওইদিন রাত নয়টার দিকে টুটুলকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে আসামিরা। দুদিন পর তার লাশ ঝোপের  মধ্যে থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া থানায় মামলা করে নিহতের পিতা মো. কামালউদ্দিন বাবু। তদন্ত শেষে চারজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় পুলিশ। পরে সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহন, যুক্তিতর্ক ও জেরা শেষে কিশোরগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. আওলাদ হোসেন ভুঁইয়া ২০১৭ সালের ৩ মে রায় দেন। রায়ে অভিযুক্ত আসামি আমিনুল হক, মো. ডালিম, মো. সোহাগ মিয়া ও মো. দুলাল মিয়াকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে আসামিরা। ডেথ রেফারেন্স আসে হাইকোর্টে।

ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানি শেষে গত ১৬ জানুয়ারি সোহাগ ও দুলালকে খালাস দেন হাইকোর্ট। ফাঁসি বহাল রাখা হয় আমিনুল ও ডালিমের। বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি বিশ্বজিৎ দেবনাথের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।

দুই আসামির খালাসের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। চেম্বার আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী এবং আসামি পক্ষে ফজলুল হক খান ফরিদ ও হেলালউদ্দিন মোল্লা শুনানি করেন। শুনানি শেষে খালাসের রায় স্থগিতের আদেশ দেয় চেম্বার আদালতের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম। একইসঙ্গে দুই আসামিকে কনডেম সেল থেকে সাধারণ সেলে স্থানান্তরের আদেশ দেওয়া হয়।

‘দরকার টাকা সেখান থেকে অপহরণের পরিকল্পনা’

ফাঁসির আসামি আমিনুল হক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘ঘটনার এক সপ্তাহ আগে আমরা চারজন মিলে পরামর্শ করি। সেখানে আলোচনা হয় যে আমাদের কিছু টাকার দরকার। সুতরাং একটা বাচ্চা অপহরণ করতে হবে। বাচ্চা অপহরণ করতে পারলে ৮-১০ লাখ টাকা আদায় করা যাবে। তখন আমরা চারজন মিলে সিদ্ধান্ত নেই যে, কামাল আহমেদ বাবুলের বাচ্চাটা অপহরণ করলে এই পরিমাণ টাকা পাওয়া যাবে। তখন পরিকল্পনামত বিকাল ৪টায় আব্দুল আউয়াল কিন্ডারগার্ডেন স্কুলের সামনে থেকে টুটুলকে অপহরণ করি আমি ও ডালিম। ময়না পাখির বাচ্চার দেওয়ার লোভ দেখিয়ে শিশুটিকে একটি পিকআপ গাড়িতে তুলে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের উচাখিলা বাজারে যাই। সেখানে আমরা নাস্তা করি। এরপর ২-৩ কিলোমিটার পরে এসে একটু বিশ্রাম নেই। পরে আমররা হোসেনপুর ব্রিজের দিকে চলে যাই।’

জবানবন্দিতে আসামি বলেন, ‘দুলাল আমাকে বলে বাচ্চাটাকে মেরে ফেলবি। এই মেরে ফেলার পরিকল্পনাটা সকলের ছিল। আরও পরামর্শ ছিলো যে, বাচ্চার মৃতদেহ ২-৩ দিন লুকিয়ে রাখতে পারলে টাকা আদায় হয়ে যাবে। প্রথমে হোসেনপুর ব্রিজের পশ্চিম পাশে যাই, গিয়ে দেখি লোকজনের সমাগম। তখন ব্রিজের পূর্ব পাশে চলে আসি। তখন বাচ্চাটি ঘুমানো ছিল। আমি বাচ্চার মুখে স্কচটেপ মারি এবং ডালিম বাচ্চার গলার মধ্যে গামছা দিয়ে প্যাঁচ দেয় এবং মেরে ফেলে। এরপর আমরা জাঙ্গালিয়া বাজারের উত্তরপাশে একটা আটার মিল আছে সেখানে বাচ্চাটির স্কুল ব্যাগ ফেলে দেই। লাশটা ওই বাজারের নামায় একটা ঝোঁপের মধ্যে ফেলে দেই। এরপর নতুন বাজারে আসি টাটা গাড়ি নিয়ে। সবাই পরামর্শ করে বাচ্চার মায়ের নম্বরে ফোন দিয়ে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাই। ফোনটা দেয় সোহাগ। পরে ৩-৪ বার ফোন দেয় দুলাল ও ডালিম। দুলাল বাচ্চার বাবার সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে চলাফেরা করত। পরে আমাদের সবাইকে গ্রেফতার করে পুলিশ।’

ইত্তেফাক/এএএম