রোদ-বৃষ্টি, ঝড়, ধুলোবালি আর শব্দদূষণ ট্রাফিক পুলিশের নিত্যসঙ্গী। দিনরাত রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। ট্রাফিক শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণেও আছে নানা বিড়ম্বনা। গাড়িচালক ও পথচারীদের বেশির ভাগেরই রয়েছে আইন না মানার প্রবণতা। আইন মানাতে গেলেই নানা ধরনের হুমকি-ধমকির মুখোমুখি হতে হয় ট্রাফিক পুলিশকে। তারপরও এসব সামাল দিয়েই দায়িত্ব পালন করেন তারা। ট্রাফিক পুলিশরা দিনে টানা আট ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কিডনি, কান, হার্টসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে সমস্যা হয় বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
এ কারণে পুলিশের পক্ষ থেকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে এক কক্ষবিশিষ্ট ট্রাফিক পুলিশের বসার স্থান তৈরি করা হয়েছে, যা ট্রাফিক পুলিশ বক্স নামে পরিচিত। একটানা দাঁড়িয়ে থাকার পর কিছুক্ষণের জন্য ঐ বক্সে গিয়ে বসে বিশ্রাম নেন ট্রাফিক পুলিশরা। ওখানে বসেও গ্লাসের ভেতর দিয়ে ট্রাফিক কার্যক্রম দেখভাল করা যায়। কিন্তু সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ট্রাফিক পুলিশ বক্স ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটাকে চরম অমানবিক আখ্যায়িত করে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের একাধিক সদস্য বলেন, ট্রাফিক পুলিশও এদেশের মানুষ। আমরা সমাজের বাইরে না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমরাই জনগণের নিরাপত্তা দিচ্ছি। একটানা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মাথা ঘোরায় ও পা ব্যথা হয়ে যায়। পুলিশ বক্সে গিয়ে কয়েক মিনিট বসে সেই কষ্ট কিছুটা নিবারণ হয়ে যায়। কিন্তু সেই বক্সও কেন ভাঙা লাগবে?
ট্রাফিক পুলিশের একাধিক সদস্য অনেকটা আক্ষেপ করে বলেন, ট্রাফিক পুলিশের ওয়াশরুমের কোনো ব্যবস্থা নেই, বৃষ্টি হলে আশ্রয় নেওয়ার কোনো জায়গা নেই, অথচ যতই প্রতিকূল পরিস্থিতি হোক না কেন আমাদের রাস্তা ছেড়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই, কাজের ফাঁকে একটু বিশ্রাম নেওয়া, বসে খাওয়াদাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই, রেকার লেখার জন্যও একটা বসার জায়গাও নেই! আমাদের ওপর এত অমানবিক আচরণ কেন? আমরাও তো মানুষ। তারা আরও বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশে রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাথরুমসহ এসি রুম থাকে ট্রাফিক পুলিশের জন্য। থাইল্যান্ডেও দাঁড়িয়ে কোনো ট্রাফিক পুলিশ ডিউটি করেন না। রুমের মধ্য থেকে গ্লাস দিয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেন। দুর্ঘটনাসহ নানা ঝুঁকির মধ্যে ব্যস্ততম সড়কে কাজ করেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। এরপরও তাদেরকেই যানজটের জন্য নিত্যদিন সাধারণ মানুষের গালমন্দ শুনতে হয়।
পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থে ট্রাফিক পুলিশকে শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি দিতে হবে। রাজধানীবাসী যখন ঘুমিয়ে থাকেন, তখন জেগে থাকে পুলিশ। তারপরও এই পুলিশের সঙ্গে যে ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, আমরা পাকিস্তানি পুলিশ। তবে মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল পুলিশ। করোনার সময় মা ছেলেকে ফেলে রেখে চলে গেছে। লাশ দাফন করার জন্য আপন লোক পাশে ছিল না। তখন কিন্তু পুলিশ তাদের দাফন করেছেন। করোনা আক্রান্ত মা-বাবাকে রাস্তায় ফেলে রেখেছিল সন্তানরা। আমরা সেই সব বাবা-মাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। আমরা যে করোনায় আক্রান্ত হতে পারি, সেদিকেও তাকায়নি। আমরা শুধু মানবতার সেবা দিয়ে যাচ্ছি। একজন ট্রাফিক কনস্টেবল বলেন, ‘আমাদের কষ্টের কি শেষ আছে? একটু পানি খাওয়ার জন্যও সরতে পারি না। একটু সরলেই রাস্তায় গাড়ির জট লেগে যায়। গায়ে পুলিশের পোশাক, কিন্তু ধুলোবালির কারণে বেশির ভাগ সময়েই তা অপরিষ্কার ময়লা থাকে।’ তিনি বলেন, ‘দাঁড়িয়ে ডিউটি করতে করতে শারীরিকভাবে যে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি, সেটা এখন টের পাচ্ছি।’
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতালের পরিচালক প্রখ্যাত নিউরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ বলেন, দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে ডিউটি করলে কোমড়ে ব্যথা হতে পারে। শিরায় রক্ত জমাট বেঁধে গিয়ে মাথা ঘোরায়। হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ওয়াদুদ চৌধুরী বলেন, দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে পায়ের শিরায় রক্ত জমাট বাঁধা হয়। হার্টের মধ্যে রক্ত চলাচল বিঘ্নিত হয়। হঠাত্ মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে মৃত্যুও হতে পারে। এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। এছাড়া অন্যান্য সমস্যাও হতে পারে। এ জন্য ডিউটির ফাঁকে ফাঁকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম প্রয়োজন।
পঙ্গু হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কোমড়ে ব্যথা, হাঁটুতে ব্যথা হতে পারে। একটানা দাঁড়িয়ে ডিউটি করা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের এক ঘণ্টা পরপর ২০ সেকেন্ডের জন্য বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন।
প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, রোদে ডিউটি করলে মানসিক চাপ থাকে। এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। উৎকণ্ঠা কাজ করে। তারা শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘক্ষণ ডিউটি করার কারণে রক্তের শ্বেতকণিকার ঘাটতি হয়। আমরা শুধু বাইরেরটা দেখি, ভেতরেরটা দেখি না। সাংসারিকভাবেও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।