বুধবার, ২৯ মার্চ ২০২৩, ১৫ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের ত্বরিত উদ্যোগে আটকে গেল খুনিদের মুক্তির প্রক্রিয়া

দুই খুনির খালাসের রায়ে ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন বাদী!

আপডেট : ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০২:৩০

একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে ছিলেন দিশেহারা। সন্তুষ্ট ছিলেন চার আসামির ফাঁসির রায়ে। সেই চার আসামির দুই জন খালাস পান আপিলের রায়ে। যারা খালাস পান সেই খুনির একজনকে ঘরবাড়ি করে দেওয়াসহ নানা আর্থিক সহায়তা করতেন সন্তান হারানো পিতা। খুনিদের খালাস পাওয়ার পর চিন্তিত ছিলেন তিনি। ইতিপূর্বে কারাগার থেকে স্বজনদের মাধ্যমে এক খুনি হুমকি দিয়েছিলেন বের হতে পারলে হত্যা করা হবে তাকে। খালাসের রায় শুনে দ্রুত ছুটে এসেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে। ঐ খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেয় অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়। দেওয়া হয় রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন। সেই আবেদনের পক্ষে সরকারি আইন কর্মকর্তার বক্তব্য শুনে মঙ্গলবার খালাসের রায় স্থগিতের সিদ্ধান্ত দেন আপিল বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। আটকে যায় মুক্তির অপেক্ষায় থাকা দুই খুনির খালাসের রায়। হাফ ছেড়ে বাঁচেন শিশুটির পিতা মো. কামালউদ্দিন বাবু।

চেম্বার আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইন কর্মকর্তা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পীকে তিনি বলেন, স্যার, খুনি দুলালই মূল কালপ্রিট। সেই তার স্বজনদের মাধ্যমে জেলখানা থেকে আমাকে বার বার হুমকি দিয়েছে। বলেছে, কারাগার বের হতে পারলে আমাকে আগে খুন করবে। যখন তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে তখন থেকেই আমি ভয়ের মধ্যে ছিলাম।

এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের ঐ কৌঁসুলি তাকে অভয় দিয়ে বলেন, ভয় নেই। খালাসের রায় স্থগিত হয়েছে। এখন হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করা হবে।

এদিকে রায় স্থগিতের এই আদেশ ঐদিন দ্রুত ফ্যাক্সযোগে গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি সেলের সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালাকে পাঠানো হয়। এর আগে দুই আসামির খালাসের হাইকোর্টের অ্যাডভান্সড অর্ডার ডেসপাস শাখা থেকে রায়ের পরদিনই ১৭ জানুয়ারি কারাগারে পৌঁছে যায় দ্রুততার সঙ্গে। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ায় মুক্তি আটকে যায় দুই খুনির।

‘দরকার টাকা সেখান থেকে অপহরণের পরিকল্পনা’

মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, শাকিবুল হাসান টুটুল ছিলেন আব্দুল আউয়াল কিন্ডারগার্টেনের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। ২০১৪ সালের ১২ আগস্ট স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে তাকে অপহরণ করা হয়। ‘ময়না পাখির বাচ্চা’ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তাকে স্কুল থেকে অপহরণ করে আসামিরা।

ফাঁসির আসামি আমিনুল হক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, “ ঘটনার এক সপ্তাহ আগে আমরা চার জন মিলে পরামর্শ করি। সেখানে আলোচনা হয় যে আমাদের কিছু টাকার দরকার, সুতরাং একটা বাচ্চা অপহরণ করতে হবে। বাচ্চা অপহরণ করতে পারলে ৮/১০ লাখ টাকা আদায় করা যাবে। তখন আমরা চার জন মিলে সিদ্ধান্ত নেই যে, কামাল আহমেদ বাবুলের বাচ্চাটা অপহরণ করলে এই পরিমাণ টাকা পাওয়া যাবে। তখন পরিকল্পনামতো বিকাল ৪টায় আব্দুল আউয়াল কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সামনে থেকে টুটুলকে অপহরণ করি আমি ও ডালিম। ময়না পাখি বাচ্চা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে শিশুটিকে একটি পিকআপ গাড়িতে তুলে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের উচাখিলা বাজারে যাই। সেখানে আমরা নাস্তা করি। এরপর দুই/তিন কিলোমিটার পরে এসে একটু বিশ্রাম নেই। পরে আমরা হোসেনপুর ব্রিজের দিকে চলে যাই।”

জবানবন্দিতে আসামি বলেন, “দুলাল আমাকে বলে বাচ্চাটাকে মেরে ফেলবি। এই মেরে ফেলার পরিকল্পনাটা সকলের ছিল। আরও পরামর্শ ছিল যে, বাচ্চার মৃতদেহ দুই/তিন দিন লুকিয়ে রাখতে পারলে টাকা আদায় হয়ে যাবে। প্রথমে হোসেনপুর ব্রিজের পশ্চিম পাশে যাই, যেয়ে দেখি লোকজনের সমাগম। তখন ব্রিজের পূর্ব পাশে চলে আসি। তখন বাচ্চাটি ঘুমানো ছিল। আমি বাচ্চার মুখে স্কচটেপ মারি এবং ডালিম বাচ্চার গলার মধ্যে গামছা দিয়ে প্যাচ দেয় এবং মেরে ফেলে। এরপর আমরা জাঙ্গালিয়া বাজারের উত্তরপাশে একটা আটার মিল আছে সেখানে বাচ্চাটির স্কুল ব্যাগ ফেলে দেই। লাশটা ঐ বাজারের নামায় একটা ঝোপের মধ্যে ফেলে দেই। এরপর নতুন বাজারে আসি টাটা গাড়ি নিয়ে। সবাই পরামর্শ করে বাচ্চার মায়ের নম্বরে ফোন দিয়ে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাই। ফোনটা দেয় সোহাগ। পরে তিন/চার বার ফোন দেয় দুলাল ও ডালিম। দুলাল বাচ্চার বাবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে চলাফেরা করত। পরে আমাদের সবাইকে গ্রেফতার করে পুলিশ।”

এ ঘটনায় করা মামলায় কিশোরগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. আওলাদ হোসেন ভুইয়া ২০১৭ সালের ৩ মে রায় দেন। রায়ে অভিযুক্ত আসামি আমিনুল হক, মো. ডালিম, মো. সোহাগ মিয়া ও মো. দুলাল মিয়াকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে আসামিরা। ডেথ রেফারেন্স আসে হাইকোর্টে।

ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানি শেষে গত ১৬ জানুয়ারি সোহাগ ও দুলালকে খালাস দেয় হাইকোর্ট। ফাঁসি বহাল রাখা হয় আমিনুল ও ডালিমের। বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি বিশ্বজিৎ দেবনাথের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।

ইত্তেফাক/এমএএম