ন্যাটোর প্রতিরক্ষমন্ত্রীরা ২০ জানুয়ারি জার্মানির রামস্টেইন বিমান ঘাঁটিতে বৈঠকে বসেছিলেন। লক্ষ্য ছিল ইউক্রেনকে ভারী অস্ত্রসহায়তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য নিরসন করা। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া মোটামুটি সুবিধাজনক অবস্থায় থাকার প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনের জন্য নতুন সহযোগিতা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপীয়রা এখনো কোনো দীর্ঘমেয়াদি নীতি ঠিক করতে পারেনি। সর্বশেষ ইউক্রেনকে সামরিক সহযোগিতা হিসেবে ট্যাংক পাঠানোকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মধ্যে মতপার্থক্য সামনে এসেছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া ইস্যুতে ইউরোপের দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। বরং এ বিষয়ে দেশগুলো এখন তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। প্রথমত জার্মানি ও ফ্রান্সের মতো কিছু দেশ বিবেচনা করছে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর রাশিয়ার সঙ্গে আবার কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক আগের মতো চালু করা যাবে। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শুলজ সম্প্রতি বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হলে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমের বাণিজ্যিক লেনদেন শুরু হবে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোনও তাই প্রত্যাশা করেন। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তিনি এরই মধ্যে বহুবার ফোনালাপ করেছেন। পশ্চিমের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা একটি বড় ইস্যু। পুতিন বারবার এ বিষয়ে তার উদ্বেগের কথা জানিয়ে এসেছেন কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো তা আমলে নেয়নি। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি যুদ্ধে গড়িয়েছে। রাশিয়ার এই উদ্বেগের কথা মাথায় রেখেই দেশটির সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক ঠিক করার কথা ভাবছে ফ্রান্স ও জার্মানি। তারা চাইছে ইউক্রেন আক্রমণ ভুল ছিল, এটি মেনে নিলে রাশিয়াকে ভুল সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হবে। মূলত জ্বালানির উচ্চমূল্যই ইউরোপের এই দেশগুলোকে রাশিয়ার সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসার কথা ভাবতে বাধ্য করছে। অন্যদিকে দেখলে জ্বালানি সংকট এই সংঘাতকে দীর্ঘায়িত করছে। জ্বালানি ইস্যু রাশিয়াকে দর কষাকষির অবস্থানে রেখেছে। স্বাভাবিকভাবে দেশটি চাইবে না এক্ষেত্রে তাদের অবস্থান দুর্বল হোক। অনেকে মনে করে এ কারণে রাশিয়ার সঙ্গে কোনো শান্তি উদ্যোগ স্থায়ী হবে না। ন্যাটো সদস্যভুক্ত কতগুলো দেশ রয়েছে দ্বিতীয় দলে। তারা রাশিয়ার সঙ্গে কোনো সমঝোতার পক্ষপাতী নয়। তাদের কথা ইউক্রেনকে এ যুদ্ধে জিততেই হবে। যদি রাশিয়া জিতে যায় তার অর্থ হবে ইউরোপের হেরে যাওয়া। রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধাপরাধ করেছে তার বিচারও তারা চায়। যে কোনো দেশের অষন্ডতার প্রতি সম্মান দেখানো একটি আন্তর্জাতিক বহুল প্রচলিত রীতি। বিভিন্ন দেশ যুগ যুগ ধরে এটি মেনে এসেছে। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর মাধ্যমে রাশিয়া হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো ছাড়াও এই রীতিটির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। এই দেশগুলো চায় যুদ্ধ থেমে গেলেও রাশিয়াকে যেন পুরস্কৃত করা না হয়। পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাতেউস মোরাউইকি এই কথার ওপর জোর দিয়ে বলেছেন, ‘হয় ইউক্রেন জিতবে অথবা ইউরোপ হারবে’। ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রধান উরসুলা ভনডার লিয়েন ন্যাটে মহাসচিব জেন্স স্টোলটেনবার্গও বিভিন্ন সময় একই রকম বক্তব্য দিয়েছেন। সপ্তাহ খানেক আগে রুশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠনের জন্য ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে বিপুলসংখ্যক ভোট পড়ে। মস্কোর প্রতি এটি এক স্পষ্ট বার্তা। এতে আপাত দৃষ্টে সমঝোতার কোনো অবকাশ রাখা হয়নি। কানাডা ও পোল্যান্ড ইতিমধ্যে রুশ বাহিনী ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গায় যেসব ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তার তথ্য সংগ্রহের জন্য বিশেষ প্রসেকিউশন টিম গঠন করেছে।
তৃতীয় আরেকটি পক্ষ রয়েছে যারা মনে করে রাশিয়া নিজেকে বদলে নিলেই কেবল ইউরোপ নিরাপদ থাকবে। তারা বলছে দেশটি এখন যেভাবে আরেকটি দেশে আগ্রাসন চালাচ্ছে, দেশটির নেতা প্রকাশ্যে মানুষ হত্যার হুমকি দিচ্ছেন সেটার তুলনা শুধু নাসি আমলের জার্মানির সঙ্গেই দেওয়া যায়। তাই দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হলে এর নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। পোল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট লেস ওয়ালেসা বলেছেন, রাশিয়াকে হয় গণতন্ত্র গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় দেশটি যেন আবার যুদ্ধ শুরু করতে না পারে সেজন্য পাঁচ থেকে ১০ বছরের মধ্যেই এর শক্তি খর্ব করতে হবে। এরজন্য রাশিয়াকে বদলাতে হবে। হয় ভেতর থেকে বদলাবে অথবা বাইরের কোনো শক্তি অনুঘটন হিসেবে কাজ করবে।
রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারী ওলাফ ও ম্যাক্রোন ক্রমেই ইউরোপে একাকী হয়ে পড়ছেন। মহাদেশটির নীতিনির্ধারক মহল প্রত্যাশা করে রাশিয়া কেবল ইউক্রেন থেকে পিছু হটবে তাই নয় বরং নিজেকে বদলে ফেলারও পদক্ষেপ নেবে। শান্তি, স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র ইউরোপীয় মূল্যবোধের প্রধান বিষয় হলেও পুতিনকে ক্ষমতায় রেখে সেগুলোর কার্যত কোনো অর্থ থাকে না। তবে পুতিনকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ইউরোপ সরাসরি কোনো হস্তক্ষেপেরও পক্ষপাতী নয়। আশা করা হচ্ছে ইউক্রেনে হোঁচট খেলে দেশে তার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হবে। যেটা তার বিদায়ের পথ তৈরি করতে পারে।