ইরাকে বাবার হাতে মেয়ে খুন হওয়ার পর পারিবারিক সহিংসতা ফের আলোচনায় উঠে এসেছে। এ ধরনের অপরাধ বন্ধ করতে আইনই যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা। ২২ বছরে তিবা আলী তুরস্কে বসবাস করতেন। তিনি সম্প্রতি ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে দিওয়ানিয়া প্রদেশের পৈত্রিক বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন।
তুরস্কে নিজের স্বাধীন উচ্ছল জীবনের ভিডিও ইউটিউবে আপলোডের মাধ্যমে সোশাল মিডিয়ায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিবা। সিরিয় প্রেমিককে বিয়ে করার পরিকল্পনা করছিলেন। এমন সময়েই তার মৃত্যুর খবর পাওয়া গেল। গত ৩১ জানুয়ারি তিবার বাবা স্বীকার করেন, মেয়েকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছেন তিনি।
তিবা হত্যার ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর ইরাকে পারিবারিক সহিংসতা ও 'অনার কিলিং' অর্থাৎ পরিবারের সম্মানরক্ষার নামে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সরব হয়েছেন নারীর অধিকার নিয়ে কর্মরত আন্দোলনকারীরা। সহিংসতা রোধে কঠোর আইনের দাবিতে সম্প্রতি রাজধানী বাগদাদে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন তারা।
ইরাকে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে কোনো আইন নেই। বরং পরিবারের নারী সদস্যদের নির্যাতন বা হত্যার পর পুরুষদের দায়মুক্তির নানা সুযোগ রয়েছে। বলা যায়, এক অর্থে নারীর প্রতি সহিংসতায় আইনি অনুমোদনই রয়েছে সেখানে।
ইরাকে দণ্ডবিধির ৩৯৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, ধর্ষণের পর ধর্ষক ভিকটিমকে বিয়ে করতে রাজি হলে অভিযোগ খারিজ হয়ে যাবে। একই দণ্ডবিধির ৪০৯ নম্বর ধারায় বলা আছে, অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কের কথা জানতে পেরে স্ত্রীকে হত্যা করলে সর্বোচ্চ তিন বছরের সাজা হতে পারে।
৪১ নম্বর প্যারায় বলা আছে, স্ত্রীর ওপর স্বামীর 'অধিকার চর্চার' সময় এ রকম ঘটে গেলে সেটা কোনো অপরাধ নয়। সামাজিক রীতি ও আইন দ্বারা পুরুষের অধিকার চর্চার বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত। তিবা আলীর মৃত্যুর পর এক বিবৃতিতে আইনের কিছু ধারা পরিবর্তন করার জন্য ইরাকের প্রতি আহ্বান জানায় জাতিসংঘ।
বাগদাদের সাংবাদিক খলুদ আহমেদ বলেন, 'আইন করে এখানে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করা সম্ভব না বলেই আমার ধারণা। তবে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সহিংসতার হার কিছুটা হলেও কমতে পারে। মানুষ যদি বুঝতে পারে অপরাধ করলে শাস্তি হবে, অথবা নারীরা কোথায় আশ্রয় পাবেন, তাহলেও অবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে।'
ইরাকে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গবেষক রাজাউ সালিহি জানান, পারিবারিক, যৌন বা জেন্ডার ভিত্তির সহিংসতার শিকার বা এর কারণে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ করার কার্যকর কোনো প্রক্রিয়াই নেই ইরাকে।
দুইটি প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে এরকম অভিযোগ দায়ের করা যায়, তবে এর কোনোটিই আইনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি। পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে গেলেও পরে আবার ভিকটিমকে তার বাড়িতেই ফিরে আসতে হয়। কারণ, তাদের কাছে প্রতিকার পাওয়ার কোনো ব্যবস্থাই নেই।
বরং অভিযোগের কারণে পাল্টা আরও বেশি নির্যাতনের শিকার হওয়ার ভয়ে নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ করেন না। এসব কারণে ইরাকে নারীর প্রতি পারিবারিক বা যৌন সহিংসতার সঠিক কোনো পরিসংখ্যানও নেই। পারিবারিক সহিংসতার ১৫ হাজারের মতো অভিযোগ প্রতি বছর আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
জনসংখ্যার অনুপাতে বিবেচনা করলে, ইউরোপের চেয়ে ইরাকে সহিংসতা কম বলে মনে হবে। ইরাকে অনার কিলিংয়ের ঘটনা বিরল নয়। তবে এর হিসাব বের করা দুরূহ। কারণ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব ঘটনাকে আত্মহত্যা হিসেবে দেখানো হয়।
মানবাধিকার কর্মীদের পাশাপাশি ইরাকি কর্মকর্তারাও এটা স্বীকার করেছেন। ব্রিটিশ কুর্দি মানবাধিকার-কর্মী রুয়াইদাহ মুস্তাফা জানান, আইন করে সাংস্কৃতিক রীতি পরিবর্তন করা সম্ভব না। পরিবর্তনের জন্য জাতীয় পর্যায়ে এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা প্রয়োজন। ইরাকে আইনি ও সামাজিক দুই কাঠামোতেই পরিবর্তন দরকার।
ইরাকের আধা স্বায়ত্তশাসিত কুর্দিস্তান অঞ্চলে 'অনার কিলিং' এর মতো অপরাধ রোধে যাবজ্জীবন সাজার বিধান রেখে ২০১১ সালে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইন পাস করা হয়। তবে এই আইনের কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা হ্রাসের কোনো প্রমাণ নেই।
বরং বিভিন্ন পরিসংখ্যানে স্পষ্ট দেখা যায়, কোভিড মহামারি ও এর পরবর্তী সময়ে এ ধরনে অপরাধ বেড়ে গেছে। আইনের প্রয়োগ না হওয়াকে এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন মানবাধিকার কর্মীরা।
কুর্দিস্তানের সুলাইমানিয়া শহরে নারীদের অধিকার নিয়ে কর্মরত সংস্থা দ্য উইমেনস অর্গানাইজেশন ফর লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্স বা ডাব্লিউওএলএ জানিয়েছে, ২০২১ সালে দায়ের করা পারিবারিক সহিংসতা বা নারী নির্যাতনের একটি মামলারও এখন পর্যন্ত সুরাহা হয়নি। বরং বিচার ব্যবস্থায় সব মনোযোগ থাকে পুরুষের বিরুদ্ধে পুরুষের অভিযোগের ওপর।
অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয়ভাবে সালিশ বসিয়ে এসব অভিযোগের নিষ্পত্তি করা হয়। সেক্ষেত্রে পারিবারিক সহিংসতা বা নারী নির্যাতনের ঘটনায় বিচার পাওয়ার সম্ভাব্যতা তখনই থাকে, যখন ভিকটিম শক্তিশালী কোনো উপজাতীয় বা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সদস্য।
২০২০ সালে ইরাকে পারিবারিক সহিংসতা রোধ সংক্রান্ত সর্বশেষ আইনটি পার্লামেন্টে তোলা হয়। ওই সময় বাগদাদ ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা আল বায়ান সেন্টার ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড স্টাডিজ এই আইন নিয়ে একটি জরিপ চালায়। ডিজিটাল জরিপে আশাতীত সাড়া পান গবেষকরা।
প্রায় ১৩ হাজার ইরাকি ২৬টি প্রশ্নের উত্তর দেন। ৮৯ শতাংশ উত্তরদাতা আইনটি সমর্থন করেন, ৯৫ শতাংশ মত দেন যে তারা স্ত্রীকে চড় মারার মতো ঘটনাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে মনে করেন। ৭৭ শতাংশ উত্তরদাতার বয়স ছিল ১৮ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে।