সোমবার, ২৯ মে ২০২৩, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বাড়ছে শিশুর ইন্টারনেট ও ডিভাইস আসক্তি

আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৫:০০

১১ বছরের আফসারা নূর ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। স্কুলের পরে বাকি সময় মোবাইল বা ট্যাবে ইন্টারনেট থেকে লেখাপড়ার কনটেন্ট ডাউনলোড করে পড়ালেখা করে। কিন্তু আফসারার রেজাল্ট ভালো হচ্ছিল না। খাওয়ার সময়ও মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে তার চোখ থাকে বলে অভিযোগ করেন তার মা। ফলে সে কী খায় বোঝে না এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেয়ে ফেলে। মেয়েটির মা যখন খাওয়া থেকে তুলে দেন, তখন সে বোঝে যে তার আর খেতে হবে না—বলেন মেয়েটির মা মনোয়ারা হোসেন।

অভিভাবকেরা বলছেন, খেলাধুলার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে মোবাইল ফোনে গেমসের প্রতি আসক্তি বাড়ছে তাদের। বিশেষ করে করোনার পর এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাসায় ইন্টারনেট সংযোগ থাকায় শিশুরা ইউটিউবে ছড়া, গান, কবিতাসহ বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রমের ভিডিও দেখছে। ফলে মোবাইল ফোনের প্রতি আসক্তি বাড়ছে। একটা সময় বিকাল হলেই শিশুরা মাঠে নেমে আসত। ক্রিকেট, ফুটবল, গোল্লাছুটসহ বিভিন্ন খেলায় মত্ত থাকত তারা। আর বাসার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে অভিভাবকেরা খেলার মাঠের শিশুদের সেই খেলা উপভোগ করত। এখন শিশুরা খেলার মাঠের অভাবে খেলছে মোবাইল-ট্যাব কিংবা ল্যাপটপের স্ক্রিনে। যাদের বাসার গ্যারেজে খেলার সুযোগ আছে, তারা কিছুটা সময় গ্যারেজে খেলতে পারছে। তবে অধিকাংশ শিশু তো খেলারই সুযোগ পায় না। ফলে ডিজিটাল ডিভাইসে নির্ভর করা ছাড়া নিরুপায় শিশু-কিশোরেরা। এতে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। 

তারা বলছেন, করোনার প্রাদুর্ভাবে যখন সবকিছু বন্ধ, তখন শিশু-কিশোরেরা গৃহবন্দি অবস্থায় হাঁপিয়ে উঠেছিল। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে তাদের মধ্যে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে অবশ্যই খেলার মাঠগুলো পুনরুদ্ধার করে একটি স্বাভাবিক ও সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তারা বলছেন, খেলার মাঠ না থাকায় শারীরিক পরিশ্রম না হওয়ায় অসংখ্য শিশু মোটা হয়ে যাচ্ছে। এতে তাদের শারীরিক বিকাশ সঠিকভাবে হচ্ছে না। এছাড়া মাঠের অভাবে শিশুরা ইন্টারনেটের দিকে ঝুঁকছে। ফলে ফোনে আসক্তি বাড়ছে এবং চোখের সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

জরিপের তথ্য :বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক জরিপের তথ্যমতে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় ২৩৫টি খেলার মাঠ আছে, কিন্তু বর্তমান জনসংখ্যার বিবেচনায় খেলার মাঠের প্রয়োজন ২ হাজার ৪০০। শুধু তাই নয়, খেলার জায়গার অভাব ঘোচাতে বর্তমানে শিশুরা উদ্বেগজনক হারে স্মার্ট ফোনের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে, যা তাদের মনস্তাত্ত্বিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপে গত বছর প্রথম আট মাসে আত্মহত্যা করা ৩৬৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৯৪ জন (৫৩.৩০ শতাংশ) স্কুলের। শিশুরা প্রতিদিন অন্তত পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা সময় ইন্টারনেটে কাটাচ্ছে, অল্প বয়স থেকে এমন বিঘ্নিত মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ পরে কিশোর বয়সে তাদের মধ্যে হতাশা ও আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি করতে পারে।

দুশ্চিন্তায় অভিভাবকেরা :অভিভাবক মাসুমা আক্তার বলেন, ‘খেলাধুলার জন্য পর্যাপ্ত মাঠ না থাকায় ছেলেমেয়েদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় প্রতিটি অভিভাবক। ছেলেমেয়েকে ভালো বিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য দুই বছর আগে শহরে এসে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেছি।’ তার ১০ বছরের ছেলেটি শহরে এসে বন্দিজীবন পার করছে। তিনি বলেন, ভালো উদ্দেশ্যে শহরে এসেছি। কিন্তু স্কুলেও ভালো মাঠ নেই। পাড়াতেও খেলাধুলার উপযুক্ত পরিবেশ নেই। ফলে বেশির ভাগ সময় বাসায় কাটায় কিংবা গ্যারেজে দৌড়াদৌড়ি করে। এতে সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ছে না। চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি হয়ে আছে।

ছোট হয়ে গেছে খেলার মাঠ :শহরের অধিকাংশ এলাকা বা স্কুলে খেলার মাঠ নেই। আর যেগুলো আছে, তা-ও চারপাশ ইট-সিমেন্টে ঢালাই করে বাঁধিয়ে ছোট করে ফেলা হয়েছে। এখন সেই সব মাঠে নিয়মিত বসে মেলা বা বাজার। ফলে কিছু মাঠ আয়তনে ছোট হয়ে গেছে।

নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরামের সভাপতি হাফিজুর রহমান ময়না বলেন, বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা অনুযায়ী, রাজধানীর ১২৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪১টি ওয়ার্ডে কোনো খেলার মাঠ নেই। শিশুদের বিনোদনের জন্য পর্যাপ্ত খেলাধুলার সুযোগ না থাকায় শিশুদের মধ্যে কম্পিউটার-মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন ডিভাইসের প্রতি আসক্তি বেড়ে গেছে। করোনাকালীন অনলাইনে ক্লাস করার কারণে এ সমস্যা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। শহরে নতুন নতুন মাঠ-পার্ক-গণপরিসর সৃষ্টির পাশাপাশি বিদ্যমান মাঠ-পার্কের যথাযথ সংস্কার এবং সব শ্রেণির মানুষের জন্য প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা হলে এ সমস্যা অনেকটাই সমাধান করা যাবে।

বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল লয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন (বেলা)-র রাইসুল হাসান বলেন, পার্ক ও মাঠের মধ্যে স্থাপনা নির্মাণ ও বাণিজ্যিকীকরণ মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০-এর স্পষ্ট লঙ্ঘন। মাঠ-পার্ক রক্ষায় সরকারকে আরও সচেষ্ট হতে হবে।

ঢাকা আইডিয়াল ক্যাডেট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এম এ মান্নান মনির বলেন, বর্তমানে বিদ্যালয়গুলোতে মাঠ না থাকায় শিক্ষার্থীরা খেলাধুলার সুযোগ পায় না। এলাকার যে বিদ্যালয়গুলোতে মাঠ রয়েছে, তা বিদ্যালয় সময়ের বাইরে এলাকাবাসীর জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার মাধ্যমে এলাকাবাসীর খেলাধুলা ও সামাজিকীকরণের সুযোগ তৈরি সম্ভব।

ইত্তেফাক/এমএএম