২০১৭ সালে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা আগমনের পর সহজলভ্যতায় এনজিওর চাকরিতে ঢুকে পড়েছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অগণিত শিক্ষার্থী। সনদ ছাড়াও কাড়ি কাড়ি টাকা বেতন পাওয়ায় সেশন সমাপ্তিতে বিমুখ হয়েছে এসব শিক্ষার্থীরা। ফলে ক্লাসে অনুপস্থিতির পাশাপাশি সমাপনী পরীক্ষায় অকৃতকার্যের হার বেড়েছে। সদ্যসমাপ্ত এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে এ বিপর্যয় ধরা পড়ার পর ভাবনায় পড়েছেন অভিভাবক মহল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। শিক্ষা থেকে প্রজন্মকে ছিটকে পড়া রদ করতে উদ্যোগী হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
এরই অংশ হিসেবে কলেজে শিক্ষার্থীদের উপস্থিত নিশ্চিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছে কক্সবাজার সরকারি কলেজ। ক্লাসে অনুপস্থিতির (ডিসকলেজিয়েট) কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ১৪৬ জন শিক্ষার্থীকে ফরম পূরণের সুযোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন।
গেল ২৬ ফেব্রুয়ারি কলেজের অধ্যক্ষ ও বিভাগীয় প্রধান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়। এ সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীরা অতীতের মতো কলেজমুখী হবে- এমন আশায় কলেজ প্রশাসনকে সাধুবাদ জানিয়েছেন অভিভাবক মহল।
সূত্র জানায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমতে ক্লাসে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে শতকরা ৭৫ ভাগ উপস্থিতি থাকতে হবে। অন্যথায় শিক্ষার্থীদের ডিসকলেজিয়েট ঘোষণা করার বিধান রয়েছে। বিধি থাকলেও তা বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কলেজ প্রশাসন। উল্টো প্রশাসনের উদাসিনতায় কলেজবিমুখ হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর স্কুল থেকে শুরু করে কলেজের শিক্ষার্থীরা চাকরির দিকে ঝুঁকে পড়ে। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার নেমে আসে ১০ ভাগে। ফলাফল বিপর্যয় দেখা দেয় কক্সবাজারের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সদ্যঘোষিত এইচএসসি পরীক্ষায় ফলাফলে বিষয়টি সবার নজরে আসে।
সূত্র আরো জানায়, উখিয়া ডিগ্রি কলেজে মারাত্মকভাবে ফলাফল বিপর্যয় হয়। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার (এইচএসসি) ফলাফলে এ কলেজের ৫৭০ পরীক্ষার্থীর মাঝে পাস করে মাত্র ১৭২ জন। যেখানে বিজ্ঞান বিভাগের ছয়জন শিক্ষার্থীর সবাই অকৃতকার্য হয়। বিষয়টি চারদিকে সমালোচনার ঝড় তোলে। এতে আগামীতে শিক্ষার্থীদের কলেজমুখী করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি বাস্তবায়নের বিকল্প কিছুই ভাবতে পারছেন না অভিভাবক মহল।
কক্সবাজার সরকারি কলেজ সূত্র জানায়, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ১৪৬ জন শিক্ষার্থীকে ডিসকলেজিয়েট ঘোষণা করে ফরম পূরণ করতে পারবে না বলে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়। কলেজের অধ্যক্ষ গিয়াস উদ্দিন ও বিভাগীয় প্রধান আবুল মনসুর স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক ৬০ শতাংশের কম ক্লাস উপস্থিতির কারণে তাদের ডিসকলেজিয়েট ঘোষণা করা হয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক আবুল মনসুর বলেন, আমার বিভাগে চতুর্থ বর্ষে মোট শিক্ষার্থী ১৬০ জন। এদের মাঝে ১৪ জন নিয়মিত কলেজে উপস্থিত থাকায় তাদের ফরম পূরণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বাকি ১৪৬ জনকে ডিসকলেজিয়েট ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের কলেজমুখী করতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, শুধু রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ নয়, কলেজে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে অন্যান্য বিভাগকেও এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এতে উপস্থিতি যেমন নিশ্চিত হবে তেমনি শিক্ষার মানও বাড়বে।
কলেজ প্রশাসনের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে কক্সবাজার পৌরসভার তারাবনিয়ার ছরা এলাকার আমিরুল ইসলাম নামে এক অভিভাবক বলেন, শিক্ষাজীবন শেষ না করতেই ছেলে-মেয়েরা টাকার মোহে পড়েছে। এতে অনেকের শিক্ষাজীবন মাঝপথেই ইতি ঘটছে।
ইয়াছিন আরাফাত নামে আরেক অভিভাবক বলেন, রোহিঙ্গা আসার পর নানা বয়সী শিক্ষার্থীরা চাকরির সুযোগ পেয়েছে। তারা নিয়মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হয় না। এতে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণে কলেজ প্রশাসনের সিদ্ধান্ত স্যালুট পাওয়ার যোগ্য।
কক্সবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ গিয়াস উদ্দিন বলেন, কলেজে সকল বিভাগ আগে থেকেই এ বিধি মেনে চলতো। মাঝখানে একটু ঢিল দেওয়া হয়। এখন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ পুনরায় কঠোর হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সকল বিভাগে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করছি সকল বিভাগই পূর্বের মতো বিধি বস্তবায়নে কঠোর হয়ে শিক্ষার্থীদের মঙ্গল বয়ে আনবে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, রোহিঙ্গা একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। মানবিক আশ্রয় দিতে গিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি এখন আমরা। এর মাঝে তাদের উপলক্ষ করে আমাদের শিক্ষার্থী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। এ থেকে উত্তরণে শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানমুখী করতে উখিয়া-টেকনাফ তথা জেলার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে।