নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের সাদিপুর ইউনিয়নের বরগাঁও গ্রামের লোকজন এখন গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছে। ঐ গ্রামে নারী ও শিশু ছাড়া তেমন কোনো পুরুষের দেখা মিলছে না। দু-এক জনের দেখা পেলেও তারা কারো সঙ্গে কথা বলছেন না। কথা বলতে চাইলেও এড়িয়ে গিয়ে উধাও হয়ে যান তারা। সোনারগাঁও থানায় র্যাবের দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার আতঙ্কে এ গ্রামের পুরুষরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
গত রবিবার রাতে র্যাব-১১-এর সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার নাছির উদ্দিন বাদী হয়ে সোনারগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় ২১ জনের নামসহ প্রায় ৭০-৮০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। র্যাবের মামলায় ইতিমধ্যে গুলিতে নিহত আবুল কাশেমের পরিবার, সদস্য ও স্বজনদের গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠিয়েছে পুলিশ। গুলিতে নিহত আবুল কাশেমের পরিবার প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। একদিকে শোকের মাতম, অন্যদিকে গ্রেপ্তার আতঙ্ক। পাশাপাশি পরিবারের উপর্জনক্ষম লোকজন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
গুলিতে আবুল কাশেম নিহত হওয়ার ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন সোনারগাঁও থানার পরিদর্শক তদন্ত মোহাম্মদ আহসানউল্লাহ।
সরেজমিনে বরগাঁও এলাকায় গিয়ে জানা যায়, গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছেন ঐ গ্রামের লোকজন। অপরিচিত কেউ ঐ গ্রামে ঢুকলেই তাদের মধ্যে কৌতুহল সৃষ্টি হয়। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ জামদানি ও কুটিরশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। যেখানে জামদানি তৈরির কারখানাগুলো কর্মব্যস্ততার মধ্যে থাকত। সেখানে কম লোকজনই কাজ করছেন। তবে এখন নারী ও কিশোররাই কাজ করছেন। পুরুষদের সেখানে দেখা মিলছে কম। এ গ্রামের মামলার ২১ জনের পরিবারের কোনো পুরুষ সদস্য বাড়িতে দেখা যায়নি। তবে র্যাবের দায়ের করা মামলার তদন্তে গিয়েছেন তালতলা ফাঁড়ি পুলিশের ইনচার্জ পরিদর্শক জাকির রাব্বানী। তিনি ঐ গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলছেন। এছাড়াও কথা বলেছেন গুলিতে নিহতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।
জাকির রাব্বানী বলেন, ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ। তদন্তের আগে কিছুই বলা সম্ভব না।
র্যাবের দায়ের করা মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার রাতে খুন হওয়া নারী গার্মেন্ট শ্রমিক রোজিনা হত্যার সঙ্গে জড়িত মো. সেলিম নামের এক আসামিকে আটক করতে শুক্রবার মধ্যরাতে বরগাঁও চেয়ারম্যানপাড়া গ্রামে যায় র্যাবের একটি দল। সেলিমের বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার শেষে নিয়ে আসার সময় সেলিম ডাকচিত্কার শুরু করে। এ সময় মামলার আসামিরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে এসে র্যাবের ওপর হামলা চালিয়ে সেলিমকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। র্যাব তখন আসামিদের বোঝানোর চেষ্টা করলে গ্রামবাসীদের নিয়ে তারা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে র্যাবের ওপর হামলা চালায়। এ সময় আসামিরা আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি ছোড়ে। তখন গুলিতে এক জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এছাড়াও আসামিদের হামলায় র্যাবের চার জন আহত হয়। এ ঘটনার পর আহত সদস্যদের হাসপাতালে ভর্তি করে র্যাব পুনরায় ঐ এলাকায় গিয়ে জানতে পারে আবুল কশেম নামের এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
গ্রামবাসী জানায়, আমির আলীর পালিত ছেলে সেলিমের গতকাল সোমবার আড়াইহাজারে পাঁচরুখি বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। বিয়েবাড়িতে গভীর রাতে অস্ত্রসহ অপরিচিত লোকজন আসায় হট্টগোল হয়। এ কারণে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসেন। স্থানীয়রা অপরিচিতদের ডাকাত বলে সন্দেহ করেন। এক পর্যায়ে ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশের সাহায্য চান। পরে স্থানীয়রা ‘ডাকাত ডাকাত’ বলে চিৎকার শুরু করলে আরো লোকজন এগিয়ে এসে জড়ো হয়। তখন নিজেদের র্যাব সদস্য বলে পরিচয় দেন অভিযানে যাওয়া ব্যক্তিরা। তখন গ্রামবাসীর সঙ্গে র্যাবের সংঘর্ষ বাঁধে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক জন মন্তব্য করেন, যেখানে র্যাবের নামে মামলা হওয়ার কথা, সেখানে উলটো র্যাব গ্রামবাসীর নামে মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। বিভিন্ন সময়ে পুলিশ আসে। আতঙ্ক সৃষ্টি করে। কখন কাকে ধরে নিয়ে যাবে সেটা বলা মুশকিল।
নিহতের পুত্রবধূ র্যাবের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া নজরুল ইসলামের স্ত্রী আমিনা বেগম বলেন, ‘আমাদের ওপর মানসিক অত্যাচার করা হচ্ছে। আমার শ্বশুরকে র্যাব গুলি করে মারল। আমার স্বামী ও সন্তানকে র্যাবের লোকজন ধরে নিয়ে গেল। ছেলেকে ছেড়ে দেওয়া হলেও স্বামীকে মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠাল। শোক শেষ করতে পারছি না, আবার মামলা করার সময় কোথায়?’
নিহতের স্ত্রী রমিজা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামীকে হত্যার পর আমাদের পরিবার এখন নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। দুই ছেলে র্যাবের মামলার আসামি। এক জন জেলে, অন্যরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আগামী দুই মাসের মাথায় এক ছেলের এসএসসি পরীক্ষা। পুরুষ বলতে বাড়িতে কেউ নেই। মামলা করব কার নামে? আমাদের মামলায় কারো কিছু হবে না। মামলা করে লাভ কি? আমার স্বামী-সন্তানদের ফিরিয়ে দেন।’
গুলিতে আহত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গ্রাম্যচিকিত্সক হুমায়ুন কবিরের স্ত্রী সুলতানা বেগম জানান, ‘এমন ঝামেলা হবে জানলে হয়তো ঐ রাতে স্বামী সন্তানকে বের হতে দিতাম না। উপকারের জন্য বের হয়ে এখন বাবা-ছেলে মামলার আসামি। আমার স্বামী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন। আসামি হওয়ার পর বেশি ভয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গ্রেফতার হলে উপায় কী হবে। এ সমস্যাগুলোর শেষ কোথায়?’
র্যাবের মামলার গ্রেপ্তার হওয়ার আসামি আমানউল্লাহর স্ত্রী রানী আক্তার বলেন, ‘র্যাব দোষ করল, কেউ বিচার করব না। আল্লাহ একদিন ঠিকই বিচার করব। আমাদের লোক মারা গেল। আবার আমাদের মামলা দিয়ে জেলে পাঠাল।’
সোনারগাঁও থানার পরিদর্শক তদন্ত মোহাম্মদ আহসানউল্লাহ বলেন, র্যাবের ওপর হামলার ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। সেই মামলায় ছয় জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। নিহত আবুল কাশেমের পরিবারের কেউ মামলা করার জন্য আসেনি।