বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রোগ নির্ণয়ের অত্যাধুনিক পদ্ধতি ‘ক্যাপসুল এন্ডোসকপি’

আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৩, ০৫:০৭

পরিপাকতন্ত্রের রোগ নির্ণয়ের একটি অত্যাধুনিক পদ্ধতি ‘ক্যাপসুল এন্ডোসকপি’। এই পদ্ধতিতে একটি ভিটামিন সাইজ ক্যাপসুল সেবনের মাধ্যমে রোগীর পরিপাকতন্ত্রের (মুখ থেকে পায়ুপথ) চলমান ও স্থির ছবি সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণ করা হয়ে থাকে। ভিটামিন ক্যাপসুল সাইজের অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ক্যাপসুলের মধ্যে রয়েছে একাধিক ক্যামেরা, লাইট, ব্যাটারি এবং তথ্য সংরক্ষণকারী ডিভাইস। 

পরিপাকতন্ত্রের রোগ নির্ণয়ের গতানুগতিক পদ্ধতির (এন্ডোসকপি ও কোলনসকপি) মাধ্যমে ছয় ইঞ্চির মতো জায়গার উপসর্গের কারণ নির্ণয় করা যায় না, কিন্তু ক্যাপসুল এন্ডোসকপি পরিপাকতন্ত্রের সব রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরকারি হাসপাতালে দেশে প্রথম বারের মতো ক্যাপসুল এন্ডোসকপি ইউনিট আজ মঙ্গলবার মহাখালী শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চালু হচ্ছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন প্রখ্যাত গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজিস্ট, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা. আজাদ খান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন জাতীয় অধ্যাপক, বিএমডিসির সভাপতি প্রখ্যাত গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হাসান। ক্যাপসুল এন্ডোসকপি রোগীকে খাওয়ানোর পর ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পেটে থাকে। তারপর পায়ুপথে তা বের হয়ে যায়। এই ১২ ঘণ্টার মধ্যে কয়েক হাজার ছবি তুলতে পারে ক্যাপসুলটি, যা কম্পিউটারে দেখতে পারেন চিকিৎসকেরা। ক্যাপসুল এন্ডোসকপির মূল্য ৪৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে রোগীর পেছনে ৫০ হাজার টাকা খরচ হবে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন, ভেজাল খাদ্যের কারণে দেশে ব্যাপক হারে বাড়ছে পরিপাকতন্ত্র, প্যানক্রিয়াস ও লিভারের রোগী। এছাড়া করোনা-পরবর্তী  সময়ে এসব রোগী যেন বেশি হয়েছে। বর্তমানে হাসপাতালে আগতদের ৪০ শতাংশই এই রোগে আক্রান্ত। জলবায়ু ও পরিবেশগত বিভিন্ন কারণে বর্তমানে গ্যাস্ট্রো ইন্টেসটাইনালজনিত রোগীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। দেশে এ ধরনের রোগী সবচেয়ে বেশি। সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় এনে পরিপাকতন্ত্র, লিভার ও প্যানক্রিয়াসজনিত গ্যাস্ট্রো ইন্টেসটিইনাল রোগে আক্রান্ত মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে রাজধানীর মহাখালীতে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে।

জাতীয় অধ্যাপক, বিএমডিসির সভাপতি প্রখ্যাত গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হাসান বলেন, গরিব ও দরিদ্র রোগীরা শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে বিনা মূল্যে বিশ্বমানের সুচিকিত্সা সেবা পাচ্ছেন, যা আগে মধ্যবৃত্তরাও আশা করতে পারত না। ক্যাপসুল এন্ডোসকপি চালু হওয়ার মাধ্যমে দেশের জনগণ বিশ্বমানের আরেকটি চিকিৎসা পেতে যাচ্ছে।

শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম কিবরিয়া বলেন, এই ইনস্টিটিউটে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিশ্বমানের। দরিদ্র রোগীরা এই হাসপাতালে বিনা মূল্যে সুচিকিত্সা পাচ্ছে। হাসপাতালে আগতদের মধ্যে কারো কারো লিভার ক্যানসার ধরা পড়ছে। সুচিকিত্সা পেলে লিভারে ক্যানসার হওয়ার সুযোগ নেই।

সারা বিশ্বে পরিপাকতন্ত্র, লিভার ও প্যানক্রিয়াসজনিত বিভিন্ন রোগের প্রকটতা রয়েছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এসব রোগের বহু রোগী রয়েছে। আর সেই সব রোগের বৈজ্ঞানিক ও আন্তর্জাতিক মানের চিকিত্সার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক ইচ্ছার ফসল হিসেবে ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর যাত্রা শুরু করে শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। সূচনালগ্ন থেকেই এই হাসপাতাল পরিপাকতন্ত্র ও লিভার-সংশ্লিষ্ট রোগের উন্নত সেবা দিয়ে আসছে। কোভিড মহামারির সময় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এই হাসপাতাল অজানা, প্রাণঘাতী এই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। কিন্তু সেই কঠিন সময়েও অত্র হাসপাতাল তার মৌলিক কাজ থেকে দূরে সরে যায়নি। বরং কোভিড যুদ্ধ এবং পরিপাকতন্ত্র ও লিভারের চিকিৎসা পাশাপাশি চলছে। ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতালে দৈনিক প্রায় ৫০০ রোগী চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য বহির্বিভাগে আসে। তাদের মধ্যে প্রায় ১০০ রোগী ভর্তি হওয়ার যোগ্য। কিন্তু শয্যাস্বল্পতার জন্য অধিকাংশ রোগী ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় না। অত্র হাসপাতালের বিশেষত্ব এর অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং আন্তর্জাতিক মানের সেবা। গত বছর এই হাসপাতালে প্রায় ৮ হাজার এন্ডোস্কপি, ২ হাজার ৫০০ কোলনস্কপি, ১ হাজার ১০০ ইআরসিপি, ১৫৭টি এন্টারোস্কপি, ১৫০টি এইচআরএম এবং ৪৫টি ইইউএস প্রসিডিউর করা হয়েছে, যা অভূতপূর্ব। সামনের বছরগুলোতে এই সংখ্যা আরো বাড়বে। ক্রমবর্ধমান রোগীর চাপ মোকাবিলা এবং আরো বেশিসংখ্যক রোগীর সেবা প্রদানের জন্য হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা বাড়ানো জরুরি।

ক্যাপসুল এন্ডোসকপি যেসব রোগ নির্ণয় করতে পারবে : ক্যাপসুল এন্ডোসকপি বিশেষত নিম্নোক্ত ক্ষুদ্রান্ত্রের রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদ্ধতি। ক্ষুদ্রান্ত্রের ক্ষত (আলসার), প্রদাহ, পলিপ, রক্তস্বল্পতার অজ্ঞাত কারণ নির্ণয়, ক্রন্স ডিজিজ, টিবি, সিলিয়াক ডিজিজ, দীর্ঘকালীন ডায়রিয়া ও পেটে ব্যথার কারণ নির্ণয় করা যায়। চিকিত্সকের পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী পরীক্ষা-পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। যেমন পরীক্ষার দিন সকাল বেলা খালি পেটে ক্যাপসুল সেবন করতে হবে। রোগী ক্যাপসুলটি গিলে ফেলার পরে এটি পরিপাকতন্ত্রের স্বাভাবিক গতিতে নিচে নামতে থাকে এবং পায়ুপথে বের হয়ে আসে। এ সময় ক্যামেরা কয়েক হাজার ছবি ধারণ করে। ক্যাপসুল সাধারণত এক থেকে তিন দিনে পায়ুপথে বের হয়ে আসে। বের হয়ে আসা ক্যাপসুলের ছবি ডাক্তাররা কম্পিউটারে ডাউনলোড করে পর্যবেক্ষণ এবং রোগ নির্ণয় করেন।

সুবিধা :ক্যাপসুল এন্ডোসকপির সুবিধাসমূহ হলো সম্পূর্ণ ব্যথামুক্ত, হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নেই, পূর্ণ স্বাভাবিক কার্যক্রম করা যায়, কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, অ্যানেস্থেশিয়া অথবা ঘুমের ওষুধের দরকার নেই, অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ক্যাপসুলের মাধ্যমে পেসমেকার বা যে কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস ইমপ্ল্যান্ট করা রোগী এই পরীক্ষা করতে পারে। ১০ থেকে ঊর্ধ্বে যে কোনো বয়সের এবং ওজনের ব্যক্তি এই পরীক্ষা করাতে পারবে।

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন