শুক্রবার, ০৯ জুন ২০২৩, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

কোনো কোনো পণ্যের দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশের বেশি

রোজায় বাজার গরম

আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২৩, ০৮:০০

নিত্যপণ্যের বাড়তি দরের চাপ নিয়েই এবার ভোক্তাদের রোজা শুরু করতে হচ্ছে। চাল থেকে ডাল, আটা, ময়দা, তেল, চিনি, মাংস, সবজি, ফল—এমন কোনো পণ্য নেই যে দাম বাড়েনি। গত এক বছরের ব্যবধানে কোনো কোনো পণ্যের দাম ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। আবার রসুন, শুকনা মরিচের মতো পণ্যের দাম বেড়েছে ১০০ শতাংশের বেশি।

ব্যবসায়ীরা বলেছেন, করোনা মহামারির ধাক্কা না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। বিশ্ব বাজারেই এসব পণ্যের দাম বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারে। তবে এ কথা মানতে নারাজ ভোক্তারা। তাদের দাবি, সিন্ডিকেট করে একটি চক্র পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। তা না হলে দাম এত বাড়বে কেন?

গতকাল বৃহস্পতিবার রোজার আগের দিন রাজধানীর শান্তিনগর বাজার, কাওরান বাজার ও তুরাগ এলাকার নতুন বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, নিত্যপণ্যের বাজার রীতিমতো চড়া। গত কিছুদিন ধরে যে পণ্যটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে সেই ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে  ২৬০ থেকে ২৮০ টাকা কেজিতে। অথচ এক বছর আগে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৫৫ থেকে ১৬৫ টাকা। গত বছর প্রতি হালি ফার্মের ডিমের দাম ছিল ৩৫ থেকে ৩৮ টাকা। যা এ বছর বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৪৭ টাকা হালিতে। গত বছর প্রতি কেজি গরুর মাংস ছিল ৬৫০ টাকা। যা গতকাল ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। খাসির মাংস এক বছরের ব্যবধানে কেজিতে ২৫০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ১০০ টাকায় উঠে গেছে।

রোজায় সাধারণত যে পণ্যগুলোর চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে এর মধ্যে রয়েছে চিনি, ডাল, আটা, ময়দা, তেল ও দুধ। গতকাল বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এসব পণ্যের প্রত্যেকটির দাম বেড়েছে লাগামহীনভাবে। প্রতি কেজি চিনির দাম গত বছর ছিল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। সেই চিনি এবার বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়। বিভিন্ন ধরনের ডালের মধ্যে অ্যাংকর কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়ে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা, ছোলা কেজিতে ১৫ টাকা বেড়ে ৮৫ থেকে ৯০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি কেজি প্যাকেট আটা বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা। যা গত বছর এ সময় ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। প্যাকেট ময়দার কেজি গত বছর ছিল ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা। এ বছর বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৭৮ টাকা। গত এক বছরের হিসেবে ভোজ্য তেলের দামটা তুলনামূলক কম বেড়েছে। তাও ১০ শতাংশের বেশি। গতকাল বাজারে ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হয় ৮৭০ থেকে ৮৮০ টাকা। যা গত বছর ছিল ৭৮০ থেকে ৮০০ টাকা। এছাড়া এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন গতকাল ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকা বিক্রি হতে দেখা গেছে। যা গত বছর এ সময় ছিল ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা। রোজায় দুগ্ধজাত বিভিন্ন খাবার তৈরির জন্য দুধের চাহিদা বাড়ে। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে প্যাকেটজাত বিভিন্ন দুধের দামও। গত বছর বিভিন্ন প্যাকেটজাত গুঁড়া দুধের কেজি ছিল ৫৮০ থেকে ৬৯০ টাকা। যা এ বছর বিক্রি হচ্ছে ৭৮০ থেকে ৮৫০ টাকা।

নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়া-কমা নিয়ে বাজারদরের প্রতিবেদন তৈরি করে সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। সেই প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত এক বছরের ব্যবধানে কোনো কোনো পণ্যের দাম ১০ শতাংশ থেকে ১১৬ দশমিক ২২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এর মধ্যে প্রতি কেজি প্যাকেট আটা ৫৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ, প্যাকেট ময়দা ৩৫ দশমিক ৪০ শতাংশ, অ্যাংকর ডালের দাম ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ, সয়াবিন তেল ১২ দশমিক ৩১ শতাংশ, ছোলা ১৭ দশমিক ২৪ শতাংশ, দেশি রসুন ১২০ শতাংশ, শুকনা মরিচ ১১৬ দশমিক ২২ শতাংশ, মানভেদে আদা ৮২ দশমিক ৬১ শতাংশ, জিরা ৬২ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগি ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ, চিনি ৫১ দশমিক ৬১ শতাংশ, ডিম ২৬ দশমিক ০৩ শতাংশ, খেজুরের দাম ২৬ শতাংশ বেড়েছে। এসব পণ্যের অনেকগুলোই গত দুই তিন মাসে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, টানা পাঁচ মাস কমার পরে গত ফেব্রুয়ারিতে দেশে মূল্যস্ফীতি আবার বেড়েছে। সার্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতিও। বিবিএসের হিসাব অনুসারে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশে। এর আগে গত বছরের আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। মূল্যস্ফীতির ঐ হার ছিল গত ১১ বছর ৯ মাসের (১৪৪ মাস) মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে বিবিএসের মূল্যস্ফীতির হিসেবের তুলনায় বাস্তবে খাদ্যপণ্যের দাম আরও বেশি বেড়েছে। 

দেশের বাজারে চিনির দাম কমানোর জন্য গত ২৬ ফেব্রুয়ারি চিনির আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ কমানো হয়। কিন্তু বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই। ১৯ মার্চ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর একটি প্রতিবেদনে জানায়, দেশে ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ খামারভেদে প্রতি কেজি ১৩৫ থেকে ১৬০ টাকা। বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লারের দাম সর্বোচ্চ ২০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হওয়া উচিত। কিন্তু খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ২৮০ টাকায়। ভোক্তারা অভিযোগ করে বলেন, তাহলে এখানে কি সিন্ডিকেট কাজ করছে না? ব্রয়লার মুরগির ‘অযৌক্তিক’ মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়ে মুরগি উৎপাদনকারী চার প্রতিষ্ঠান কাজী ফার্মস লিমিটেড, আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেড, সিপি বাংলাদেশ ও প্যারাগন পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেডকে গতকাল তলব করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

এদিকে চিনি, ডাল, তেলের পাশাপাশি রোজা উপলক্ষে বাজারে সবজি, ফলের দাম আরও এক দফা বেড়েছে। গতকাল বাজারে বিভিন্ন ধরনের সবজির মধ্যে প্রতি কেজি পটোল ৮০ থেকে ১০০ টাকা, ঢ্যাঁড়শ ৭০ থেকে ৮০ টাকা, টম্যাটো ৪০ টাকা, শসা ৭০ থেকে ৮০ টাকা, বেগুন ১০০ টাকা, বরবটি ৮০ টাকা, শিম ৬০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা, মুলা ৪০ থেকে ৫০ টাকা, গাজর ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। লেবুর দাম বেড়েছে লাগামহীনভাবে। প্রতি হালি লেবু বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকায়।

বেড়েছে মাছের দামও। গতকাল বাজারে বিভিন্ন ধরনের মাছের মধ্যে প্রতি কেজি রুই ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকা, কই ২৪০ থেকে ২৮০ টাকা, চিংড়ি ৫৫০ থেকে ৮০০ টাকা, তেলাপিয়া ২২০ থেকে ২৬০ টাকা, পাঙাশ ২০০ থেকে ২২০ টাকা, পাবদা ৩৮০ থেকে ৪৫০ টাকা, শোল ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা, ট্যাংরা ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা, শিং ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

সব ধরনের ফলের দামও বেড়েছে। গতকাল বাজারে বিভিন্ন ধরনের ফলের মধ্যে ভালো মানের খেজুর প্রতি কেজি ৭০০ থেকে ১২০০ টাকা,  কমলা ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা, তরমুজ ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, আপেল ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা, মালটা ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা, আঙ্গুর ৩৫০ থেকে ৩৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। অথচ সপ্তাহখানেক আগেও এসব ফল কেজিতে ১০ থেকে ৫০ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। এতে স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী মানুষের পাশাপাশি যারা কম বেতনের চাকরিজীবী তাদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে খাদ্যপণ্যের যে মূল্যস্ফীতি তা অনেক বেশি। এই অর্থনীতিবিদ বলেন, পণ্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য শুধু আন্তর্জাতিক বাজারের দোষ দিলে হবে না। এটা ঠিক, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে। কিন্তু দেশের কিছু অসাধু ব্যবসায়ীও পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত টাস্কফোর্স এর সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব  পণ্যের যথেষ্ট মজুত রয়েছে। কোনো পণ্যের ঘাটতি নেই। কেউ কৃত্রিম উপায়ে কোনো পণ্যের অবৈধ মজুত করে মূল্য বৃদ্ধির চেষ্টা করলে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী ভোক্তাদের একসঙ্গে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য না কেনার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, একসঙ্গে বেশি পণ্য কিনলে বাজারে চাপ পড়ে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘রমজান উপলক্ষে বাজারে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে আমরা কাজ করছি। এজন্য নিয়মিত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করছি। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা রাখেন না। এ বিষয়ে এবার আমরা কঠোর অবস্থান নিয়েছি। রমজানে বাজারে অভিযান জোরদার করা হবে বলে তিনি জানান।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন