মঙ্গলবার, ৩০ মে ২০২৩, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস: সমসাময়িক ভাবনা

আপডেট : ২৫ মার্চ ২০২৩, ১২:৪৪

যে কোনো জাতিরাষ্ট্রের আত্মপরিচয়ের অন্যতম নিয়ামক হলো সে দেশের জাতীয় দিবস। প্রজাতন্ত্র দিবস, বিপ্লব দিবস কিংবা স্বাধীনতা দিবস যে নামেই অভিহিত হোক না কেন জাতীয় দিবস একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয়কে সূদীর্ঘকাল ধরে পরিচিতি দেয়। ব্রিটেন ও ডেনমার্ক ব্যতিত পৃথিবীর সব দেশই কোনো না কোনো নামে জাতীয় দিবস উদ্‌যাপন করে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ১৯৭১ সালে হলেও বাংলা জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভব বহুকাল পূর্বের। সমসাময়িক ভাবনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের প্রেক্ষাপট এককভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভক্তিকে কেন্দ্র করে আলোচিত হলেও বাঙালির জাতি রাষ্ট্রের উৎপত্তির গোড়ার কথা জানবার কিংবা জানাবার অভিপ্রায় ইতিহাসের পাঠক বা লেখক দুই শ্রেণির মধ্যেই লক্ষ্যণীয়ভাবে অনুপস্থিত।

১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ২৬ মার্চ দিনটিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সরকারি ছুটি উদ্‌যাপনের এক সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এই দিনটির তাৎপর্য পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টতঃ যে ইতিহাস দৃশ্যমান হয় তা হলো মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র। যে ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক বিষয়গুলো বিধৃত হয়েছে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের রাজেনৈতিক পরিক্রমায় বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১টা ৩০ মিনিট অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পরপরই বঙ্গবন্ধু কে অতি গোপনে ঢাকার কুর্মিটোলা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। ৩০ মার্চ অতি সঙ্গোপনে তাকে করাচিতে পাঠানো হয়। গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে একটি ঘোষণাপত্র চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী, এমএ হান্নানের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ওয়্যারলেসে পাঠানোর ব্যবস্থা করে যান। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রটি ছিল-

'This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and whatever you have, to resist the army of occupation to the last your fight must go on until the last solder of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved'

এই তার বার্তাটির মুদ্রিত হ্যান্ড বিলই ২৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখ ভোরের মধ্যে চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় পৌঁছে যায়।

মেজর মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন ভূঁইয়া, এইসি

কিন্তু যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এই ঘোষণা সরকার কর্তৃক গৃহীত হওয়া। যা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে কার্যকরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে অধ্যাপক ইউসুফ আলী গঠিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়-

'We further resolve that this proclamation of independence shall be deemed to have come into effect from 26th day of March 1971'

মুলত স্বাধীনতা বা জাতীয় দিবস কেন্দ্রিক আলোচনার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জাতি রাষ্ট্রের উৎপত্তির যে বিষয়টি আলোকপাতের দাবি রাখে তা হলো বাঙালি জাতি সত্ত্বা। বাঙালি জাতির ভাষা ও সংস্কৃতিকে মুক্ত করবার যে লড়াই এ অঞ্চলের মানুষের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল তার সূচনাটা ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে নিহিত ছিল। লাহোর প্রস্তাবে ভাষা, সংস্কৃতি এবং ভূ-খন্ড ভিত্তিক যে জাতি রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছে তাতে মুলত: বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বীজ নিহিত ছিল। লাহোর প্রস্তাবকে উপেক্ষা করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি এবং পরবর্তীতে রাজনৈতিক শোষণ ও নিষ্পেষনের মাধ্যমে বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়কে নিশ্চিহ্ন করার যে দুরভিসন্ধি তা বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের সৃষ্টিকে ত্বরান্বিত করে।

ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হওয়া একটি রাষ্ট্রের জন্মের এক বছরের মধ্যে সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার যে উদ্ধতপূর্ণ ঘোষণা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে দিয়েছিলেন (২১ মার্চ ১৯৭১) তা পূর্ব বাংলার মানুষকে তাঁদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন করেছিল।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীকে স্তিমিত করতে পাকিস্তান সরকার যে বর্বোরোচিত আচরণ ও হত্যাযজ্ঞের আয়োজন করে তা মূলতঃ পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের গণ মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয় নিয়ে বাঙালি জাতি রাষ্ট্র গঠনের পথ তৈরি করে দেয় মাত্র পাঁচ বছরের মাথায়। ভাষার প্রশ্নে বাঙালি আপোষ করেনি। কিন্তু ভাষার অধিকার আদায়ের পরও কি গণ মানুষের মুক্তির আন্দোলন স্তিমিত হয়েছে। রাষ্ট্র বনাম জনতার দুরত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে বরং আরও বেশি। সেই আদিকাল থেকে শাসক কথা বলেছে সংস্কৃতি, ফারসি কিংবা ইংরেজিতে কিন্তু শোষণের শিকার গণ মানুষের কথা বলেছে তাদের নিজস্ব ভাষায়। যে ভাষায় মানুষের সংস্কৃতি আর আত্মপরিচয়ের উন্মেষ ঘটে। এই সংস্কৃতি আর আত্মপরিচয়ের পতাকাকে যিনি হিমালয়ের মতো উঁচু করতে বাঙালির প্রতিটি স্বাধিকার আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য উৎসর্গ করেছেন তার যাবতীয় উচ্চাকাঙ্খা। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে শুধু নয়; গণ মানুষের অধিকারকে শোষক শ্রেণির রাহুগ্রাস মুক্ত করতে তিনি বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের পথ উন্মোচনে নেতৃত্ব দিয়েছে, ৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট ৬৬ এর ছয়দফা ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান ৭০ এর নির্বাচন আর ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ছিল সেই রাজনৈতিক পর্যায়ের ধারাবাহিক সোপান।

একটি শোষণমুক্ত রাষ্ট্র গঠনের পাশাপাশি বাঙালির আত্মপরিচয়কে জাগিয়ে তোলার আন্দোলন তিনি শুরু করেছিলেন পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই।

আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ধারণায় জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভবের যে মাপকাঠি বিদ্যমান তাতে ভাষা, সংস্কৃতি আর আত্মপরিচয়কে শাসক শ্রেণির কবল থেকে মুক্ত করবার ইতিহাস বোধ করি খুব কমই আছে। সমসাময়িক সময়ে ইউক্রেন-রাশিয়া যে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে তাঁর অন্যতম একটি কারণও ভাষা, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের লড়াই।

মুক্তিযুদ্ধের অর্ধ শতাব্দীকাল পেরিয়ে স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপনে বাঙালি জাতি সত্ত্বার শেকড় অন্বেষণে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা-চেতনার মাধ্যমে আমাদের আত্মপরিচয় নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোকে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি আর আত্মপরিচয়ের অন্বেষণে আমাদের মতো ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। পাশাপাশি উত্তর আধুনিকতার আগ্রাসনে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রামও করতে হয়নি।

ইত্তেফাক/কেকে