শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

দুবাইতে বাড়ছে বাড়ি ভাড়া, কারণ কি রুশদের আগমন?

আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২৩, ১২:১৬

আরেখা প্রেটোরিয়াসের জন্য ফেব্রুয়ারি আর মার্চ মাসটা ছিল অনিশ্চয়তা আর উৎকণ্ঠায় ভরা। কারণ, তিনি ও তার স্বামী ক্রিস কয়েক সপ্তাহ ধরেই দুবাই শহরে নতুন একটি বাড়ি খুঁজছিলেন। তারা ২০১৯ থেকে শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি বাড়িতে থাকছিলেন, কিন্তু বাড়িওয়ালা গত বছরই তাদের নোটিশ দেন যে তাদেরকে উঠে যেতে হবে, কারণ ওই বাড়িতে তিনি নিজেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

সমস্যা হলো, ক্রিস ও আরেথা তিন বেডরুমের ভিলা বাড়িটির ভাড়া দিচ্ছিলেন বার্ষিক ৩৪ হাজার ডলার। কিন্তু এখন তারা ওই একই এলাকায় নতুন বাড়ি খুঁজতে গিয়ে দেখতে পেলেন, সমমানের বাড়ির ভাড়া ৭৫% বেড়ে গেছে। তারা শহরের অন্য এলাকাতেও বাড়ি খুঁজতে শুরু করলেন, কিন্তু তাদের বাজেটের মধ্যে কোন ভিলা বাড়ি পেলেন না।

তিনি ও তার স্বামী ক্রিস কয়েক সপ্তাহ ধরেই দুবাই শহরে নতুন একটি বাড়ি খুঁজছিলেন।

শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তারা শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে অনেক দূরে এবং বেশ ছোট একটি বাড়ি নিতে বাধ্য হলেন। কিন্তু তারও দিতে হবে বার্ষিক ভাড়া ৪৫ হাজার ডলার, যা এখনকার চাইতে ৩২% বেশি। এই দম্পতি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দুবাইতে এসেছিলেন ২০১১ সালে, আর তার পর থেকে পাঁচবার বাড়ি বদলেছেন।

তবে পছন্দমত বাড়ি খুঁজে পাওয়াটা আগে কখনো এবারের মত কষ্টকর ছিল না, আর বাড়ি ভাড়া এত বেশি বাড়তেও তারা কখনো দেখেননি। একটি রিয়েল এস্টেট এজেন্সি বলেছেন, গত বছরের পর থেকে দুবাইতে বাড়ি ভাড়া ৩৬ শতাংশ বেড়ে গেছে। দুবাই ছেড়ে সপরিবারে শারজাহ দুবাইতে গত কিছুকালের মধ্যে শুধু ভিলা নয়, অ্যাপার্টমেন্টসহ সব রকম বাড়ির ভাড়াই বেড়ে গেছে।

শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তারা শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে অনেক দূরে এবং বেশ ছোট একটি বাড়ি নিতে বাধ্য হলেন।

এই বৃদ্ধির পরিমাণ এতই বেশি যে কিছু লোককে বাধ্য হয়ে দুবাই ছাড়তে হয়েছে। ওয়াকার আনসারি তাদেরই একজন। তিনি সপরিবারে দক্ষিণ দুবাইয়ে এক বেডরুমের একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন। তার বার্ষিক ভাড়া ছিল ৯ হাজার ৫০০ ডলার। কিন্তু গত মাসে তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হবার সময় বাড়িওয়ালা বললেন, তিনি ভাড়া আরও ৩ হাজার ডলার বাড়াতে চান।

ওয়াকার তখন ওই একই এলাকায় অন্য একটি অ্যাপার্টমেন্টে খোঁজ করলেন। কিন্তু তিনি দেখলেন সেগুলোর ভাড়া আগের চাইতে ৪০ শতাংশেরও বেশি বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, 'আমি ১০-১৫ শতাংশ বেশি ভাড়া দিতে রাজি ছিলাম, কিন্তু তাতেও আমি অন্য কোন এলাকায় একটি ভালো অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজে পাইনি। তখন আমার সামনে একমাত্র বিকল্প ছিল দুবাই ছেড়ে শারজাহ চলে যাওয়।'

তিনি সপরিবারে দক্ষিণ দুবাইয়ে এক বেডরুমের একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন।

শারজাহ দুবাইয়ের পাশেই আরেকটি আমিরাত, যেখানে বাড়ি ভাড়া অপেক্ষাকৃত কম। বেটারহোমস নামে একটি রিয়েল এস্টেট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিচার্ড ওয়েইন্ড জানিয়েছেন, দুবাইয়ে বর্তমানে বাড়ির সংখ্যার তুলনায় চাহিদা অনেক বেশি বেড়ে গেছে।

তিনি বলেন, 'দুবাইতে এখন অনেক বেশি লোক বসবাস করতে আসছে এবং তারা এমন সব এলাকায় থাকতে চায় যেখানে তত বেশি বাড়ি খালি নেই। বাজারে একটা সরবরাহের অভাব আছে এবং এ কারণে ভাড়া বেড়ে যাচ্ছে।'

শারজাহ দুবাইয়ের পাশেই আরেকটি আমিরাত, যেখানে বাড়ি ভাড়া অপেক্ষাকৃত কম।

সংযুক্ত আরব আমিরাত এমন একটি দেশ যেখানকার প্রায় এক কোটি বাসিন্দার ৯০ শতাংশই বিদেশী নাগরিক। সম্প্রতি দুবাইতে শুধু ভাড়া নয়, বাড়ি কেনার দামও বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর অ্যাপার্টমেন্টের দাম বেড়েছে ৩৫%।

তবে অনেকে বলছেন, এখানে বাড়ি ভাড়া এবং বাড়ির দাম দুটোই বেড়ে যাবার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে রাশিয়ান অর্থ। গত বছর ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই এটা ঘটছে, বলছেন দুবাই ভিত্তিক সাভিল্স মিডল ইস্ট এর সহযোগী পরিচালক কেটি বার্নেল।

সংযুক্ত আরব আমিরাত এমন একটি দেশ যেখানকার প্রায় এক কোটি বাসিন্দার ৯০ শতাংশই বিদেশী নাগরিক।

ধনী রুশদের বিশেষত অলিগার্ক, কোটিপতি ও নতুন ব্যবসায়িক উদ্যোগ প্রতিষ্ঠাতাদের জন্য নতুন নিরাপদ আবাসভূমি হয়ে উঠেছে দুবাই। নতুন চাকরির সুযোগের কারণে অনেক তরুণ রুশও এই বিলাসবহুল শহরটিতে চলে এসেছেন। বেশ কিছু বহুজাতিক কোম্পানিও তাদের স্টাফদের রাশিয়া থেকে দুবাইতে নিয়ে এসেছে।

গত বছর দুবাইয়ের রিয়েল এস্টেট খাতে সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী ছিল রুশরা। মিজ বারনেল বলছেন, 'রুশরা কোথায় বাস করতে পারে বা বাড়ি কিনতে পারে এর ওপর এমন অনেক রকম বিধিনিষেধ আছে। কিন্তু সংযুক্ত আরব আমিরাতে এরকম কিছুই নেই। এখানে তারা ব্যবসা ও আর্থিক কার্যক্রম চালাতে পারছে।'

ধনী রুশদের বিশেষত অলিগার্ক, কোটিপতি ও নতুন ব্যবসায়িক উদ্যোগ প্রতিষ্ঠাতাদের জন্য নতুন নিরাপদ আবাসভূমি হয়ে উঠেছে দুবাই।

এসব কারণে দুবাইয়ের প্রপার্টি মার্কেটে যে দামই হাঁকা হচ্ছে তা তারা দিতে আপত্তি করছে না। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার পর ঠিক কত লোক রাশিয়া ছেড়েছেন তার কোন সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। তবে অনুমান করা হয়, এ সংখ্যা কয়েক লক্ষ হবে।

ফর্বস রাশিয়ার এক রিপোর্ট অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট পুতিন রুশ বাহিনীতে নতুন সেনা নিয়োগের উদ্যোগ নেবার পর ৭ লাখ রুশ নাগরিক দেশ ছেড়েছেন। ক্রেমলিন অবশ্য এই রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ ব্যাপারে একটা নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে আমিরাত। 

এসব কারণে দুবাইয়ের প্রপার্টি মার্কেটে যে দামই হাঁকা হচ্ছে তা তারা দিতে আপত্তি করছে না।


তারা রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি বা ইউক্রেনে অভিযান চালানোর সমালোচনাও করেনি। নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়নি এমন রুশদের ওপর পশ্চিমা দেশগুলো বিধিনিষেধ আরোপ করলেও, ইউএই তাদেরকে ভিসা দিচ্ছে। রাশিয়ার এমটিএস ব্যাংককে সেদেশে কার্যক্রম শুরুর লাইসেন্সও দিয়েছে দেশটি।

কোভিড মহামারির পর থেকে ভিসার ব্যাপারে কিছু উদার নিয়মনীতি করার পর এ দেশটিতে বহু বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা এসেছেন এবং নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। দেশটিতে গত বছর বাড়ি বেচাকেনার লেনদেন হয়েছে ৮৬ হাজার, যা এক নতুন রেকর্ড। 

তারা রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি বা ইউক্রেনে অভিযান চালানোর সমালোচনাও করেনি।

যত বাড়ি বিক্রি হয়েছে তার মোট মূল্য ৫ হাজার ৬০০ কোটি ডলারেরও বেশি। এটাও ২০২১ সালের চেয়ে ৮০ শতাংশ বেশি। দুবাইতে বাড়ি ভাড়া অতিরিক্ত বাড়িয়ে দেয়া বা উপযুক্ত কারণ ছাড়া ভাড়াটে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আইন আছে।

কিন্তু তার পরও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক ভাড়াটে বিবিসিকে জানিয়েছেন, তারা বাড়ি ছাড়ার যে নোটিশ পেয়েছেন তাতে বলা হয়েছে, বাড়িওয়ালা নিজেই এখন সেখানে থাকতে চান। কিন্তু আসলে এটা ছিল একটা অজুহাত মাত্র। আসলে তারা চাইছেন আরও বেশি ভাড়ায় অন্য কাউকে ভাড়া দিতে।

ইত্তেফাক/ডিএস