শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি

পাহাড়ের কোলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মারক

আপডেট : ০১ এপ্রিল ২০২৩, ০৪:৩০

১৯৩৯ সাল। বিশ্ব জুড়ে শুরু হয়েছে যুদ্ধের দামামা। চারদিকে বোমার আওয়াজ। অস্ত্রের গর্জন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এ সর্বগ্রাসী মরণছোবল ভারতীয় উপমহাদেশের যেসব জায়গায় লেগেছিল, এর অন্যতম কুমিল্লা। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে সেই যুদ্ধের স্মৃতিময় স্থান কুমিল্লার ময়নামতি রণসমাধিক্ষেত্র। যা ‘কমনওয়েলথ যুদ্ধসমাধিস্থল’ বা ‘ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি’ নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক স্থানটি কুমিল্লা মহানগর থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের পশ্চিমপাশে সেনানিবাস লাগোয়া ময়নামতি পাহাড়ের কোলে সাড়ে ৪ একর ভূমি জুড়ে ছায়াঘেরা স্নিগ্ধ নৈসর্গিক পরিবেশে অবস্থিত। এ স্থানটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অম্লান স্মারকচিহ্ন বহন করে চলেছে। এখানে প্রায় সময় দেশি-বিদেশি পর্যটক-গবেষকসহ দর্শনার্থীদের আনাগোনা লক্ষ করা যায়। সমাধিস্থল ও আশপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কারো নজর কাড়ে। 

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সমাধিস্থল এলাকায় সবুজ ঘাসের গালিচায় শোভা পাচ্ছে হরেক রকমের ফুল। গাছগাছালি ঘিরে সুনসান নীরবতা। সমাধিক্ষেত্রটির প্রবেশমুখে রয়েছে একটি তোরণ ঘর। এর ভেতরের দেওয়ালে এই সমাধিক্ষেত্রের ইতিহাস ও বিবরণ ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় লেখা রয়েছে। ভেতরে যাওয়ার জন্য রয়েছে প্রশস্ত পথ, যার দুই পাশে সারি সারি কবরের ফলক। সৈন্যদের ধর্ম অনুযায়ী তাদের কবর ফলকে নাম, মৃত্যু তারিখ, পদবির পাশাপাশি ধর্মীয় প্রতীক রয়েছে। প্রশস্ত পথ ধরে সামনে রয়েছে সিঁড়ি দেওয়া বেদি, এর ওপরে শোভা পাচ্ছে খ্রিষ্টধর্মীয় প্রতীক ক্রুশ। বেদির দুই পাশে রয়েছে আরও দুটি ঘর। এসব ঘরের মধ্যদিয়ে সমাধিক্ষেত্রের পেছন দিকের অংশে যাওয়া যায়। সেখানেও রয়েছে আরও বহু কবর ফলক। প্রতি দুটি কবর ফলকের মধ্যখানে আছে একটি করে ফুলগাছ। এছাড়া পুরো সমাধিক্ষেত্রে রয়েছে সৌন্দর্যমণ্ডিত অনেক গাছ। কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালপালা ছড়িয়ে আছে। ঝিরঝিরে বাতাসে রং-বেরঙের ফুল ও বাহারি পাতার গাছ দোল খাচ্ছে। যেন গাছগুলোও ফুল ছিটিয়ে যোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। এ এক অন্যরকম দৃশ্য, চোখ ফেরানো যায় না। প্রকৃতির নান্দনিক শোভা এই ওয়ার সিমেট্রিকে আরও সুশোভিত করে তুলেছে।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সংঘটিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৪৫ হাজার কমনওয়েলথ সৈনিক নিহত হন। তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে মিয়ানমার, আসাম ও বাংলাদেশে ৯টি রণসমাধিক্ষেত্র তৈরি করা হয়। এর অন্যতম একটি হচ্ছে ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি। এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত ১৩টি দেশের ৭৩৭ জন যোদ্ধার মধ্যে মুসলিম ধর্মের ১৭২ জন, বৌদ্ধ ধর্মের ২৪ জন, হিন্দু ধর্মের দুই জন এবং বাকিরা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। এদের মধ্যে ৫৬৭ জন নাবিক, ১৬৬ জন বৈমানিক ও তিন জন সৈনিকের সমাধি রয়েছে। নিহত সৈনিকদের মধ্যে যুক্তরাজ্যের ৩৫৭ জন, কানাডার ১২ জন, অস্ট্রেলিয়ার ১২ জন, নিউজিল্যান্ডের চার জন, দক্ষিণ আফ্রিকার এক জন, অবিভক্ত ভারতের ১৭৮ জন, রোডেশিয়ার তিন জন, পূর্ব আফ্রিকার ৫৬ জন, পশ্চিম আফ্রিকার ৮৬ জন, জাপানের ২৪ জন এবং বার্মা, বেলজিয়াম ও পোল্যান্ডের এক জন করে সৈনিকের সমাধি রয়েছে।

কমনওয়েলথ গ্রেভ ইয়ার্ড কমিশন এ যুদ্ধ সমাধিক্ষেত্র তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে। প্রতি বছর নভেম্বর মাসের প্রথমার্ধে সব ধর্মের ধর্মগুরুদের সমন্বয়ে এখানে একটি বার্ষিক প্রার্থনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। দিনটিতে কমনওয়েলথভুক্ত দেশের হাইকমিশনার, প্রতিনিধিগণকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। পরে তারা যুদ্ধ সমাধির হলিক্রস পাদদেশে ফুলেল শ্রদ্ধাঞ্জলির মধ্য দিয়ে নিহত সৈনিকদের স্মরণ করেন। এ সময় বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে। ঐ প্রার্থনা ও স্মরণ অনুষ্ঠান শেষে কমনওয়েলথভুক্ত দেশের প্রতিনিধিগণ ও চিরনিদ্রায় শায়িত সৈনিকদের আত্মীয়-পরিজনরা সমাধিস্থল পরিদর্শনসহ দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করেন। তারা দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরেন। অসংখ্য দর্শনার্থীও নিহত সৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। বছরের অন্যান্য সময়ও এখানে দর্শনার্থীদের আনাগোনা লেগেই থাকে।

ইত্তেফাক/এমএএম