শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

৫৮০ টাকায় গরুর গোশত বিক্রি করে ভাইরাল ‘কালু কসাই’

আপডেট : ০১ এপ্রিল ২০২৩, ২২:০৬

বাজারদরের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম দামে মাংস বিক্রি করে সাড়া ফেলেছেন বগুড়ার গাবতলী উপজেলার কদমতলী তিনমাথা মোড়ের নজরুল ইসলাম ওরফে কালু কসাই। বাজারদরের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম দামে মাংস বিক্রি করে সাড়া ফেলে এখন তিনি ভাইরাল হয়ে গেছেন। 

শহরের বিভিন্ন হাটবাজারে যখন ৭০০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে, ঠিক তখন গাবতলীর নশিপুর ইউনিয়নের শিমুলতলী মোড়ে নজরুল ইসলাম ওরফে কালু কসাই ৫৮০ টাকা দামে গরুর মাংস বিক্রি করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন। প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত টাটকা এ গোশত কিনতে জেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ ভিড় করছেন। এ দোকানে কয়েকদিন আগে প্রতি কেজি মাংসের দাম ৫৫০ টাকা ছিল। স্থানীয় প্রভাবশালীর চাপে ওই ব্যবসায়ী ৩০ টাকা বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। প্রায় এক বছর ধরে বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে গরুর মাংস বিক্রি করছেন কালু কসাই।

জানা গেছে, বগুড়ার গাবতলী উপজেলার নশিপুর ইউনিয়নের শিমুলতলী গ্রামের নজরুল ইসলাম ওরফে কালু কসাই (৬০) ২৬ বছর ধরে গরুর মাংসের ব্যবসা করছেন। বিভিন্ন হাটবাজার থেকে গরু কিনে এনে জবাই করে টাটকা মাংস বিক্রি করেন তিনি। তিন সস্তানের জনক কালু কসাইয়ের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে হোসাইন আল মাহমুদ অনার্সে ও ছোট ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। হোসাইন আল মাহমুদ লেখাপড়ার পাশাপাশি বাবাকে ব্যবসায় সহযোগিতা করছেন। আগে বাগবাড়ী বাজারে দোকান ছিল। তখন শহরে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হতো ৬০০ টাকা এবং বাগবাড়ী হাটে ৫৫০ টাকা। সে সময় তিনি ৫০০ টাকা কেজি দরে মাংস বিক্রি করতে থাকেন। এতে দিন দিন তার দোকানে ক্রেতা বাড়তে থাকে।

একটি গরু জবাই করলে হাটের ইজারাদারকে চার হাজার টাকা টোল দিতে হয়। এ নিয়ে ইজারাদারের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে তিনি সেখানে ব্যবসা না করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রায় এক বছর আগে বাড়ির কাছে শিমুলতলী তিনমাথা মোড়ে মাংসের দোকান দেন। বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পূর্বে গাবতলী উপজেলার নশিপুর ইউনিয়নের শিমুলতলী মোড়ে। বাগবাড়ী সড়কের এ মোড়ে নজরুল ইসলাম কালু কসাইয়ের ‘গোশত ঘর’ খুব পরিচিত। শহর থেকে ৬০ টাকা ভাড়ায় অটোরিকশায় যাতায়াত করা যায়। যাতায়াতে ৬০ টাকা খরচ হলেও বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী ক্রেতাদের সাশ্রয় হচ্ছে অন্তত ৬০ টাকা।
শুক্রবার সকালে গাবতলীর শিমুলতলী তিনমাথা মোড়ে কালু কসাইয়ের ‘গোশত ঘর’-এ গিয়ে দেখা যায় ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। 

বগুড়া শহর ছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন উপজেলার ক্রেতারা গোশত কিনতে লাইন ধরেছেন। বগুড়া শহরের আটাপাড়ার ব্যবসায়ী মহিদুল ইসলাম মোটরসাইকেল নিয়ে গোশত কিনতে এসেছেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর তিনি পাঁচ কেজি গোশত কেনেন। শহরে ৭০০ টাকা কেজি হলেও ৫৮০ টাকা দরে কেনায় তার ৬০০ টাকা সাশ্রয় হয়। যদিও মোটরসাইকেলে তার ৫০ টাকার পেট্রোল খরচ হয়। 

পার্শ্ববর্তী সোনাতলা উপজেলার স্কুল শিক্ষক মতিউর রহমান ফেসবুকে দেখে কালুর দোকানে গোশত কিনতে এসেছেন। তিনি তার নিজের ছয় কেজি ও এক পড়শির জন্য চার কেজি গোশত কেনেন। প্রতি কেজিতে শতাধিক টাকা সাশ্রয় হওয়ায় তিনি খুব খুশি। 

সারিয়াকান্দির হোটেল ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম তার হোটেলের জন্য ১৫ কেজি মাংস কিনতে এসেছেন। তিনি জানান, কালু কসাইয়ের কাছ থেকে মাংস কিনলে তার বেশি লাভ হয়। তবে ওই হোটেল ব্যবসায়ী জানান, মাংসের দাম কম হলেও ইচ্ছামতো কেনা যায় না। কসাই গরুর মাথা ও চামড়া বাদে তার ইচ্ছামতো তেল ও হাড় দিয়ে থাকেন।

গাবতলীর বালিয়াদীঘি গ্রামের ব্যবসায়ী সামসুল ইসলাম জানান, তিনি আগে থেকে ফোনে কালু কসাইকে ১০ কেজি মাংস আলাদা করে রাখতে বলেছিলেন। তাই তিনি এসে খুব সহজে গোশত নিয়ে ফিরতে পারলেন। 

কালু কসাইয়ের এক আত্মীয় জানান, কয়েকদিন আগে ৫৫০ টাকা কেজি দরে মাংস বিক্রি করা হতো। হঠাৎ করে কেজিপ্রতি ৩০ টাকা বৃদ্ধি করা হয়। 

নিজগ্রামের চাকরিজীবী ফেরদৌস হোসেন বলেন, এক বছর ধরে নজরুলের দোকানে কম দামে মাংস বিক্রি হচ্ছে। প্রথম দিকে ৫০০ টাকা কেজি দরে মাংস বিক্রি হতো এখানে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পর ৫৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি শুরু হয়। কম দামে মাংস বিক্রির ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এর পর থেকে শহর থেকে লোকজন এখানে মাংস কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ইজারাদারদের চাপে এখন ৫৮০ টাকা কেজি দরে মাংস বিক্রি করছেন তিনি।

কালু কসাই জানান, আগে বাগবাড়ী হাটে দিনে একটা গরুর মাংসও বিক্রি করতে পারতেন না। এখন সপ্তাহে ৩৫-৪০টা গরু জবাই করে বিক্রি করছেন। সপ্তাহের অন্যদিন ৪-৫টি হলেও শুক্রবার ৯-১০টা গরু জবাই করতে হয়। চারজন কর্মচারীর মজুরি বাদ দিয়ে গরু প্রতি ৫০০ টাকা থাকলেও মাসে তার ৫০ হাজার টাকা লাভ থাকে। তার মতো অন্য কসাইরাও হাটের বাইরে দোকান দিয়ে কম দামে মাংস বিক্রি করতে পারেন। এতে লাভ কম হলেও মানুষের উপকার হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

তার ছেলে হোসাইন আল মাহমুদ জানান, একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ ৩০ কেজি ও সর্বনিম্ন ১০০ গ্রাম গোশত কিনতে পারছেন। যদিও আগে তারা পাইকারি এক মন থেকে তিন মন পর্যন্ত বিক্রি করতেন। এতে নিম্ন আয়ের মানুষরা গোশত কিনতে পারতেন না। 

তিনি বলেন, তারা সব সময় সুস্থ গরু কিনে ক্রেতাদের সামনে জবাই করে টাটকা গোশত বিক্রি করেন। 

তিনি আরও বলেন, কমদামে গোশত বিক্রি করায় অন্য ব্যবসায়ীরা (কসাই) তাদের ওপর বিরক্ত। কম দামে বিক্রি না করতে নানামুখী চাপের মুখে আছেন। এরপরও প্রশাসন সহযোগিতা করলে তারা সবসময় বাজারদরের চেয়ে কম দামে মাংস বিক্রি করবেন। 

বাজারদরের চেয়ে কম দামে মাংস বিক্রি করার কারণ জানতে চাইলে হোসাইন আল মাহমুদ বলেন, ৭০০ টাকা কেজি দাম দিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে মাংস খাওয়া সম্ভব নয়। তাই নিম্ন আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে কম দামে গরুর মাংস বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

গাবতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফতাবুজ্জামান আল ইমরান জানান, নজরুল ইসলাম কালু কসাই সততার সঙ্গে কম লাভে মাংস বিক্রি করলে উপজেলা প্রশাসন তাকে সহযোগিতা করবে।

ইত্তেফাক/পিও