বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি

অপরাধ বাড়ছে সারাদেশে

**অন্যতম কারণ মাদক **মনিটরিং জোরদারের নির্দেশ পুলিশ সদর দপ্তরের

আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০২৩, ১২:৪৭

সারাদেশে অপরাধ বাড়ছে। জেলা-উপজেলা ও গ্রামাঞ্চলে খুন, চুরি, ডাকাতি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ মাদক। গ্রামের বেকার যুব সমাজ মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। মাদকের এলাকার ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে অপরাধ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। আবার মাদক সেবনকারীরা অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে খুনসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে। প্রতিদিনই এই ধরনের খুন, ডাকাতি ও চুরির ঘটনার খবর আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধিরা পাঠাচ্ছেন। হঠাৎ অর্থ-বিত্তের মালিক হতে দলীয় এক শ্রেণির নেতাকর্মীরা এখন মাদক ব্যবসা বেছে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সবাই ঐক্যবদ্ধ। এদিকে থানাগুলোর কার্যক্রম নিয়মিত মনিটরিং হয় না। এই সুযোগে থানার এক শ্রেণির পুলিশও নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে।

পুলিশ হেডকোয়ার্টারের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সারা দেশে ৭০৯ জন খুন হয়েছেন। এই সময়ে ৭৮টি ডাকাতি ও ২ হাজার ৩০৬টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। ২০২২ সালে ৩ হাজার ১২৬ জন খুন, ৪০৬টি ডাকাতি ও ৯ হাজার ৫৯১টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। তবে ঘটনার তিন ভাগের এক ভাগও থানায় রেকর্ড হয় না। কারণ পুলিশের কাছে অভিযোগ দিতে গিয়ে মানুষ চরম হয়রানির শিকার হয়। প্রতিকারের চেয়ে হয়রানি বেশি হয়। এ কারণে ডাকাতি ও চুরির বেশির ভাগ ঘটনা নিয়ে মানুষ থানা পুলিশের কাছে যেতে চান না। আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধিরা বলেন, ভূমি বিরোধের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় পুলিশ মীমাংসা করে দেন। অনেকের জমি দখলও করে দেন। বর্তমানে অনেক যুবক বেকার। করোনার কারণে বেকার হয়ে শহর ছেড়ে গ্রামেও গেছেন অনেকে। তাদের অনেকেই শুরু করে দিয়েছেন মাদক ব্যবসা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে কোনো কোনো চেয়ারম্যান ও মেম্বার এলাকা ভাগ করে মাদক ব্যবসা করে যাচ্ছেন।  ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় এসব মাদক ব্যবসায়ী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। একজন মেম্বারও কোটি টাকা খরচ করেন নির্বাচনে। চেয়ারম্যান ব্যয় করেন কয়েক কোটি টাকা। অনেক ক্ষেত্রে দলীয়ভাবে এদের নামই কেন্দ্রে পাঠানো হয়।

দেশে-বিদেশে পুলিশের ভালো কাজের ভূমিকা অনেক। মানবিক পুলিশের অনন্য উদাহরণ হিসেবে করোনা সংকট মোকাবিলায় পুলিশের বৈচিত্র্যময় ভূমিকাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। তবে থানা পুলিশের এক শ্রেণির সদস্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ায় সব অর্জন যেন ম্লান হচ্ছে। কিন্তু এটি যেন দেখার কেউ নেই। থানাগুলোর উপরে আছে সার্কেল। এই দায়িত্বে রয়েছেন অতিরিক্ত এসপি। এর উপরে আছে এসপি। এসপি কার্যালয়ে অতিরিক্ত এসপি আরও দুই জন আছেন। তার উপরে আছেন ডিআইজি। অর্থাৎ মনিটরিং করার জন্য কর্মকর্তার কোনো অভাব নেই। কিন্তু অধিকাংশই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন না। একাধিক ডিআইজি ইত্তেফাককে বলেন, অনেক এসপি আছেন, যাদের এসপি হওয়ার যোগ্যতা নেই। সঠিকভাবে তারা দায়িত্ব পালন করেন না। বসে বসে শুধু টোল কালেক্ট করেন। মাদক ব্যবসায়ী, ভূমি দখলদারসহ রাজনৈতিক দুষ্টু চক্রের সঙ্গে তাদের সখ্যতা রয়েছে। একটি রেঞ্জের ডিআইজি বলেন, তিন জন এসপি দুর্নীতি, অনিয়মে জড়িত। এমনকি নারী কনস্টেবলের সঙ্গে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িতও আছেন একজন। কনস্টেবলকে যৌন হয়রানির কারণে তিনি সাসপেন্ডও হয়েছিলেন। কিন্তু এখন আবার একটি জেলার এসপি হিসেবে বহাল আছেন। এদের দিয়ে কি কাজ হবে? আবার ওসি হওয়ার যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ওসির পদে বসে তারা দুর্নীতি ছাড়া কিছুই বোঝেন না। যদিও কিছু এসপি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন, মনিটরিংও করছেন। থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নিয়োগে নীতিমালার ৯০ শতাংশই মানা হচ্ছে না। নীতিমালার চেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে অর্থ ও রাজনৈতিক তদবির। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন তাদের অনেকে।

আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, আমরা প্রতি মাসে নিয়মিত ক্রাইম কনফারেন্স করি। ডিআইজি ও এসপিরা সেখানে থাকেন। তিনি বলেন, থানাগুলোর কার্যক্রম মনিটরিং করার কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেউ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে যা যা করণীয় তাই করা হবে। বর্তমান আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ক্লিন ইমেজের মানুষ হিসেবে পুলিশ বিভাগে সুপরিচিত।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের গ্রামাঞ্চলে মাদক ছড়িয়ে পড়েছে। যুব সমাজ খুন-খারাপিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এখন কিছু বোঝা না গেলেও অদূর ভবিষ্যতে এর ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটবে। তাই মাদককে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। পুলিশ হেডকোয়ার্টারের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার দায়ে প্রতি বছর আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার পুলিশ সদস্যের চাকরি চলে যায়। এটা অন্য কোনো বিভাগে নেই। অর্থাৎ পুলিশে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়। তারা বলেন, মনিটরিং না করার কারণে থানা পুলিশের এক শ্রেণির সদস্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। মেট্রোপলিটন এলাকায় অনেক ডিসি আছেন, যারা ডিসি হওয়ার যোগ্য নন। যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে এসপি-ডিসিদের নিয়োগ দেওয়া উচিত। কিন্তু অযোগ্যদের কারণে অনেক নিষ্ঠাবান পুলিশ পদোন্নতি পান না। দলবাজ ও টাকার মূল্যায়ন বেশি হয়। নব্য দলবাজরা পুলিশের জন্য বড় বিপজ্জনক। 

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন