বিরিয়ানির জন্য মানুষের পাগলামির কোন সীমা নেই। আর এই পাগলামিই দিল্লির বাসিন্দা অনিরুদ্ধ সুরেসানকে উদ্বুদ্ধ করেছে বিরিয়ানির জন্য হাজার মাইল দূরের শহর হায়দ্রাবাদ থেকে সেখানকার বিখ্যাত বিরিয়ানি অর্ডার করতে।
একইসঙ্গে তিনি লখনৌ থেকে ভেড়ার মাংস দিয়ে তৈরি টুণ্ডে কাবাব আর কলকাতা থেকে বাঙালি মিষ্টিও অর্ডার করেছিলেন। কিন্তু অর্ডারের পর কেমন ছিল তার অভিজ্ঞতা? তিনি বলছেন, যা আশা করেছিলেন তার ধারেকাছেও নয়।
তিনি বলেন, 'বিরিয়ানি ছিল অখাদ্য, বিরিয়ানি বলতে যা বোঝায় তার কিছুই এতে ছিল না। যত গরমই করা হোক না কেন ওই টুন্ডে কাবাবের আসল মজাটা ফিরিয়ে আনা যাবেনা। একইভাবে দিল্লির কোন স্থানীয় মিষ্টির দোকানও কলকাতার ওই মিষ্টিকে হার মানাতে পারবে।'
মিস্টার সুরেসান এমন হাজার হাজারো ভারতীয়দের একজন যারা ফুড ডেলিভারি অ্যাপ জোমাটো’র আন্তঃনগর প্রকল্পে এভাবে বাজি ধরছেন এবং বিরিয়ানি, রসগোল্লা ও কচুরির মতো খাবারে তাদের রসনা-তৃপ্তির জন্য আক্ষরিক অর্থেই এ ধরনের পাগলামিতে মেতেছেন।
ভারতের অন্তত ১০টি শহরের প্রায় ১২০টি নামকরা রেস্তোরাঁর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে জোমাটো অ্যাপ কোম্পানি, যারা ফ্লাইটের মাধ্যমে ভারতের নানা প্রান্তের প্রসিদ্ধ মুখরোচক খাবারগুলো ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে দেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। কোম্পানিটিতে এই বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে থাকা কামায়ানি সাধওয়ানি জানান, মূল আইডিয়াটাই ছিল দূরত্বের বাধা পেছনে ফেলে পুরো দেশকে একটা থালায় নিয়ে আসা।
দক্ষিণ দিল্লি ও গুরগাঁওয়ের মতো রাজধানীর অবস্থাপন্ন এলাকার বাসিন্দাদের দিয়ে আগস্টে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমবারের মতো এই সেবা চালু করে জোমাটো। এরপর মুম্বাই ও বেঙ্গালুরুসহ ছয়টি শহরে সেবা বিস্তৃত করা হয়। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সেবাটি সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে বর্তমানে কাজ করছে কোম্পানিটি।
সাধওয়ানি বলেন, 'নস্টালজিয়া ও অন্বেষণ এ দুটো বিষয়কে কেন্দ্র করেই সেবাটি চালু হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য ছিল, গ্রাহকদের চাহিদা দুইভাবে পূরণ করা- নিজ শহরের রান্নার স্বাদের মাধ্যমে তাদের শিকড়ের সঙ্গে মানুষের সংযোগ স্থাপনে সাহায্য করা এবং আমাদের দেশের রান্নার যে বিশাল সংস্কৃতি তার বিস্তৃত পরিসর আবিষ্কারের সুযোগ করে দেওয়া।'
বিবিসি এমনই অন্তত আরও নয়জন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলেছে- যারা মিস্টার সুরেসানের মতোই প্রকল্পটিকে 'খুব বেশি আগ্রহোদ্দীপক' মনে করেননি। তবে সাধওয়ানি বলেন, 'গ্রাহকদের প্রতিক্রিয়া আমাদের সব প্রত্যাশাকে ব্যাপকভাবে ছাড়িয়ে গেছে।' যদিও তিনি কর্মকাণ্ডের পরিধি সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু জানাতে অস্বীকার করেন।
জোমাটো গ্লোবাল গ্রোথের ভাইস প্রেসিডেন্ট সিদ্ধার্থ ঝাওয়ার বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকাকে গত বছর বলেছিলেন, 'যখন আমরা শুরু করি, তখন আমরা ভেবেছিলাম এভাবে খাবার পৌঁছে দেয়া বেশ ব্যয়বহুল এবং বিলাসিতা হবে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খরচের বিষয়টি আমাদের বিশ্বাস করাতে পেরেছে যে এটি কোন বিলাসিতা নয়।'
ডেলিভারির খরচ কমানো থেকে শুরু করে বড় অঙ্কের ডিসকাউন্ট দেয়া ও দ্রুত খাবার পৌঁছে দেয়া– পরীক্ষামূলক কোনো ক্ষেত্রই জোমাটোর জন্য নতুন নয়। ২০০৮ সালে চালু হওয়ার পর থেকে ভারতের তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ খাদ্য বাজারে মুনাফা অর্জনের জন্য কোম্পানিটি ক্রমাগতভাবে তাদের লজিস্টিকসের পরিধি বাড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারিতে রেস্তোঁরাগুলো অনলাইনে যেতে বাধ্য হওয়ায় আউটসোর্স ডেলিভারির জন্য জোমাটোর মতো অ্যাপের উপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে, যা প্ল্যাটফর্মটির ব্যবসায়িক মডেল সফল করতে অনেকটাই সাহায্য করেছে।
মুম্বাই-ভিত্তিক ডিজিটাল সম্পাদক ও খাদ্য বিষয়ক বই 'টিফিন অ্যান্ড হুজ সামোসা ইজ ইট এনিওয়ে?' এর লেখক সোনাল ভেদ বলেন, 'লকডাউনের মাসগুলোতে খাদ্য সরবরাহ সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। কারণ অন্য সময় খাবার ডেলিভারিতে আগ্রহ না থাকা নামী দামী রেস্তোরাঁগুলোকেও কীভাবে খাবার প্যাকেজ করে পাঠাতে হয় তা শিখতে হয়। জোমাটোর এই আন্তঃনগর সেবা সম্ভবত সেটারই বাড়তি সংযোজন।'
তবে হাজার হাজার মাইল দূরত্বে ঠিকঠাকভাবে বিরিয়ানি পৌঁছে দেয়া মোটেও সহজ কোন চ্যালেঞ্জ নয় উল্লেখ করে জোমাটোর দাবি, যাত্রাপথে খাবার নিরাপদ রাখতে তাদের সর্বোচ্চ যত্ন নিতে হয়।
খাবার সংরক্ষণ করতে তারা তাপসহায়ক বাক্স এবং অত্যাধুনিক মোবাইল রেফ্রিজারেশন ব্যবহার করে, যাতে করে খাবার হিমায়িত করতে হয় না বা কোনো ধরনের প্রিজারভেটিভও যোগ করতে হয় না। এছাড়াও প্ল্যাটফর্মটির সঙ্গে যুক্ত অনেক রেস্তোরাঁর আগে থেকেই কুরিয়ার সংস্থার মাধ্যমে আন্তঃনগর ডেলিভারির ব্যবস্থা রয়েছে, যা প্রকল্পটিকে সফল করতে সাহায্য করেছে।
কলকাতার বিখ্যাত মিষ্টির দোকান বলরাম মল্লিক এবং রাধারমন মল্লিক সুইটসের পরিচালক সুদীপ মল্লিক বলেন, 'তবে জোমাটো আন্তঃনগর খাবার ডেলিভারির এই প্রকল্প একটা সাড়া ফেলেছে এবং আমাদের পণ্যগুলোকে বিখ্যাত করেছে। আর এই কারণে সারা ভারত থেকে আমাদের অর্ডার আসছে।'
প্ল্যাটফর্মটিতে মল্লিক প্রধানত তাদের বিশেষ খাবারগুলো বিক্রি করেন– যার মধ্যে আছে বিশেষভাবে বেক করা রসগোল্লা ও সন্দেশ– যা ভালোভাবে পরিবহনের জন্য বিশেষ বাক্সের মধ্যে প্যাক করা হয়। ভারতে উৎসবের মৌসুম হল শীতকাল। এ সময় অর্ডারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ে বলে জানান মল্লিক।
তিনি আরও বলেন, 'এক পর্যায়ে তাল সামলাতে আন্তঃনগর ডেলিভারি দেয়ার জন্য আমাদের কাউন্টারে প্রতিদিনের বিক্রি বন্ধ করে দিতে হয়েছিল।' অন্যান্য রেস্তোরাঁগুলোও জানিয়েছে, তারা গ্রাহকদের কাছ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাচ্ছে।
বিরিয়ানি ও হালিমের জন্য বিখ্যাত হায়দ্রাবাদের পিস্তা হাউসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর শোয়েব মোহাম্মদ বলেছেন, 'এটি দুর্দান্ত প্রকল্প'। সপ্তাহান্তে তারা এখন গড়ে ১০০ টিরও বেশি ডেলিভারি পাঠায় যার বেশিরভাগই অর্ডার আসে দিল্লি ও মুম্বাই থেকে। তিনি বলেন, 'সম্প্রতি আমরা একদিনে ৮০০টি বাক্স সরবরাহ করেছি।'
সেপ্টেম্বরে পিস্তা হাউস খবরে এসেছিল। দিল্লির কাছে গুরগাঁওএর একজন গ্রাহক তার টুইটে অভিযোগ করেন, তিনি তার বিরিয়ানির অর্ডারের জায়গায় সালন বা তরকারির একটি ছোট বাক্স পেয়েছেন। মোহাম্মদ জানান, জোমাটো সেই হারানো অর্ডার ট্র্যাক করে এবং বিনামূল্যে তাকে বিরিয়ানি দিয়ে অভিযোগ সমাধান করেছে। এটি প্ল্যাটফর্ম ও রেস্তোরাঁর জন্য ভাল বিজ্ঞাপন হয়ে গেছে।
তবে মান ধরে রেখে সারা দেশে এই সেবা নিশ্চিত করার বিষয়ে অসুবিধাগুলো উল্লেখ করে এই প্রকল্পেরর দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সাংবাদিক সোহিনী মিটার বলেন, 'নস্টালজিয়ার প্রতি ভারতীয়দের ভালবাসার কারণে কাগজ-কলমে এই ধারণাটি দুর্দান্ত হলেও পরিবহনের দীর্ঘ সময় ও অতিরিক্ত চাপযুক্ত কোল্ড চেইন কাঠামোর কারণে ইতোমধ্যেই জোমাটোর জন্য এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রকল্প।'
অনেকে এমন প্রশ্নও তুলছেন, কোলাহলপূর্ণ বাজার ও অলিগলি রাস্তার ভেতর ঐতিহ্যবাহী এইসব বিখ্যাত জায়গায় খাওয়ার অভিজ্ঞতার স্বাদ কি আসলেই বাড়িতে তৈরি করা সম্ভব? মিটার বলেন, 'আমি মনে করি না যে কোল্ড চেইন কাঠামোয় ব্যবহার করা প্লাস্টিকের পাত্রে এসব খাবারের জাদু ধরে রাখা সম্ভব। আসলে এসব টাটকা খাওয়ার স্বাদ এবং আসল জায়গায় খাওয়ার মজাটাই তো হারিয়ে যায়।'
এ বিষয়ে একমত সুরেসান। তিনি বলেন, 'হায়দ্রাবাদের হোটেল শাদাবের মতো জায়গায় হেঁটে যাওয়ার মধ্যেও একটি ব্যাপার আছে, যেখানে মশলা ও মাংসের গন্ধ আপনাকে একশ হাত দূর থেকেও আকর্ষণ করে। ভাবুন আপনি জমজমাট ভিড়ের মধ্যে বসে আছেন আর আপনার প্লেটে ধোঁওয়া ওঠা গরম বিরিয়ানি পরিবেশন করা হচ্ছে। তার প্রতিটি কামড়ই বিরিয়ানির খুশবুতে ভরা। পাশেই দাঁড়িয়ে একজন ওয়েটার- যে আপনি চাইলেই ছোট বাটিতে তরকারি আর রাইতা ভরে দিচ্ছে।'
ভেদ জানান, ব্যক্তিগতভাবে তিনিও কোন একটি বিখ্যাত জায়গায় বসে সেখানকার নামকরা বিরিয়ানি খেতে পছন্দ করবেন। কিন্তু এআই ও লজিস্টিকস ব্যবহার করে যদি বাড়িতে বসে মানুষ সেই আনন্দ উপভোগ করতে চায়, তাহলে ব্যবসার জন্য তা অবশ্যই সুখবর।