শুক্রবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

দেশে দেশে ঈদের রকমারি খাবার 

আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০২৩, ১০:২৬

টানা একমাস সিয়াম সাধনার পর একটি দিন মুসলমানরা আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন। বিভিন্ন দেশে সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য আছে। কিন্তু মৌলিক অনুভূতি হিসেবে আনন্দের রূপ তো একই। ঈদের দিনের বিরাট অংশজুড়েই থাকে খাবারের চিন্তা। বিশেষ দিনে বিশেষ কিছু খাবারের ধকল নেন গৃহিণীরা। বাড়িতে পোলাওয়ে ম ম ঘ্রাণে পেটে ক্ষুধা চলে আসে। বাড়ি বাড়ি মেহমানরা যান। সেখানে খাবারের আইটেমের প্রতি আলাদা নজর রাখা হয়। বিশ্বায়নের যুগে এখন আমরা পুরো পৃথিবীর দিকে তাকাতে পারি। অন্য দেশের মানুষ এই আনন্দ ভাগাভাগির ক্ষেত্রে কেমন খাবারের আয়োজন করে? খাদ্য-রসিক বাঙালির কাছে স্বভাবতই এই প্রশ্নটি শুরুতে আসবে। তাদের সুবিধার্থে আজকের এই লেখায় আমরা বিভিন্ন অঞ্চলের ঈদের খাবারের ঐতিহ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। 

দক্ষিণ এশিয়ায় সেমাই ছাড়া আপ্যায়ন হয় না


ঈদের দিনটা শুরু করতে হয় মিষ্টি খাবার দিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার ঈদ মানেই মিষ্টি জাতীয় খাবারের আয়োজন। মিষ্টি জাতীয় খাবারে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশগুলোতে ঈদের সকাল শুরু হয়। ঈদের দিন সকালে ঘিয়ে ভাজা বা দুধে ভেজানো সেমাই দিয়ে সকালটা শুরু করা হয়। ঘি, চিনি দিয়ে তৈরি সুস্বাদু সেমাই রান্না করা হয়ে থাকে ভিন্ন স্বাদে। অনেকে আবার ঘন দুধ ও নারকেলের ঝুড়ি দিয়ে তৈরি করে থাকে সেমাই। পাকিস্তান ‘শির খুরমা' নামে বিশেষ ধরনের সেমাই তৈরি হয়। এটি তাদের দেশে জাতীয় খাবার। এছাড়া ঈদের দিন বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন ধরনের খাবার যেমন, জর্দা ,সেমাই,কুনাফা, ক্ষীর, ফিরনি প্রভৃতি খাবারের প্রচলন রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। মূল উপাদান অধিকাংশ ক্ষেত্রে একই। সেমাই কিংবা পায়েস। অঞ্চলভেদে ফারাক থাকতেই পারে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় ঈদ এলেই বাড়ি বাড়ি সেমাইয়ের মিষ্টি ঘ্রাণ আপনাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাবে। 

রাশিয়ার আছে মানতি


পূর্ব ইউরোপের দেশ রাশিয়ার জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ মুসলিম। রাশিয়ার ঈদের দিনের অনেকের কাছে পছন্দের খাবার-মানতি। সহজ কথায় যাকে আমরা মোমো বা ডাম্পলিং বলে চিনি। মাখানো আটার পুটলির মাঝে থাকে ভেড়া কিংবা গরুর মাংসের কিমার পুর। এরপর তা ভাপে সেদ্ধ করা হয়। আমাদের দেশে বানানো মাংস-পিঠার মতোই এটি। তবে রাশিয়ানরা ওপরে আটার পুটলিটা পাতলা করে বানায়। মাখন আর ক্রিমের সঙ্গে ডাম্পলিং পরিবেশন করা হয়। তবে এলাকাভেদে এই খাবারের স্বাদে কিছুটা তারতম্য রয়েছে।

চীনের ঈদে শানজি


চীনে মুসলিমের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি ৩০ লাখ।  এখানেও তাই ঈদ আয়োজনে উৎসবের উৎসাহ থাকে। চীনের সিংহভাগের কাছে ঐতিহ্যবাহী একটি খাবার শানজি। ময়দার কাই দিয়ে মোটা করে নুডুলস বানিয়ে ডুবো তেলে কড়া করে ভাজা হয়। তারপর তা পিরামিডের মতো করে সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়। চীনের মুসলিম অধ্যুষিত শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের খুবই জনপ্রিয় খাবার এটি।

মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যবাহী মামোউল কুকি


মধ্যপ্রাচ্যেও মিষ্টিজাতীয় খাবার দিয়েই ইদের আপ্যায়ন করা হয়। রাসুল (সা.)-এর  সুন্নত অনুযায়ী মিষ্টিকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে মধ্যপ্রাচ্যে সেমাই নয় বরং মামোউল বেশি জনপ্রিয়। বাড়িতে বানানোর মিষ্টি হিসেবে এটি দারুণ একটি খাবার। দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা মধ্যপ্রাচ্যে এই রেসিপি সিরিয়া ও লেবাননে দেখা যায়।মাখন দিয়ে তৈরি কুকিতে থাকে খেজুর,আখরোট ও পিস্তাচিও। সঙ্গে জড়ানো চিনির গুঁড়ো তো আছেই। ঠিক মামোউলের মতো কুকিই আবার ইরাক, সুদান, মিশরে পাওয়া যায়। তবে এর নাম একটু ভিন্ন। প্রায় একইরকম এই কুকিকে এই দেশগুলোতে ডাকা হয় ক্লেইচা। 

মাংসপ্রিয় মিশরের খাবার ফাতা


আফ্রিকান অঞ্চলে ইদের আয়োজন মানেই মাংস। যেকোনো ঐতিহ্যবাহী খাবারে তারা মাংস রাখবেই। পিরামিডের দেশ মিশরে ফাতা তেমনই এক খাবার। ভাত, মাংস, পেঁয়াজ, ভিনেগার সবকিছুর মিশ্রণে ভালোভাবে এটি রান্না করা হয়। গরম গরম পরিবেশন করা হয় সবার সামনে। ফাতার পাশাপাশি কাহক নামের আরেকটি দারুণ জনপ্রিয় কুকি বা বিস্কুট ছাড়া মিসরীয়দের ঈদ মোটেও জমে না। 

টার্কিশ ডিলাইড লোকুম


তুরস্ক বিশ্ব মুসলমানদের ইতিহাসে অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি দেশ। এমনকি খাবারের ঐতিহ্যেও তাদের নামডাক রয়েছে। তুরস্কে ঈদকে ‘সেকের বায়রামি'বলা হয়। এখানেও নানা ভারি খাবারের আয়োজন হয়। তবে তুরস্কে ঈদ মানেই 'লোকুম' নামক একটি মিষ্টিজাতীয় খাবার। ‘লোকুম' হরেক রকমের মিষ্টির টুকরো দিয়ে তৈরি করা হয়। বরফ আকৃতির বিশেষ এই মিষ্টি তুরস্কের সব ঘরেই ঈদের দিন তৈরি করা হয়। ‘লোকুম’নামক এই টার্কিশ ডিলাইট শিশুদের প্রিয় খাবার।

ব্রিটেনে বিরিয়ানিটাই চলে বেশি


দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মত ব্রিটেনের মুসলিমদের কাছে ঈদের দিনে জনপ্রিয় একটি খাবার হলো -বিরিয়ানি। মাংস,চাল বিভিন্ন মশলা দিয়ে তৈরি এই বিরিয়ানির সাথে থাকে দই এবং পুদিনার চাটনি। ব্রিটেনে বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা কারণ এখানে জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশ দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত। এখানে অনেকেই ইদের দিন সেমাই বা অন্যান্য খাবার আয়োজন করে। তবে মুসলমান নন এমন মানুষদেরও আপ্যায়ন করা হয়। তাদের কাছে বিরিয়ানিটাই বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলে ব্রিটেনে ঈদ হলে বিরিয়ানির আয়োজন ছাড়া উপায় থাকে না। 

সোমালিয়ার মাংসপিঠা


আফ্রিকা অঞ্চলে সচরাচর মাংসকে বিশেষ আয়োজনে ব্যবহার করা হয়। অনেকটা দারিদ্রপীড়িত রাষ্ট্র সোমালিয়াও তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবারে মাংস ব্যবহার করে। পাতলা রুটি বা প্যানকেকের মত দেখতে খাবারটি সোমালিয়ায় খুবই জনপ্রিয়। এই ঐতিহ্যবাহী প্যানকেক মাংস বা সবজির সঙ্গে পরিবেশন করা হয়।চিনি এবং দই দিয়ে আলাদাভাবেও খাওয়া হয়। ইথিওপিয়ায় এটির নাম -ইনজেরা।

মরক্কোর তাজিনে


ঝাল ঝাল মাংসের রেসিপি মরোক্কোর ‘তাজিনে’।মূলত এই খাবারটি ধীরে ধীরে রান্না করা স্ট্যু।ভেড়ার অথবা গরুর মাংস দিয়ে তৈরি হলেও এর সঙ্গে নানারকম ফল ও সবজি থাকে।আলজেরিয়ায় এই খাবার যথেষ্ট জনপ্রিয়। 

ইন্দোনেশিয়া-কেটুপাত


বিশ্বে সর্বাধিক মুসলিমের বসবাস ইন্দোনেশিয়ায়। কাজেই এখানে যথাযথ ধর্মীয়ভাব ও গাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ঈদ উদযাপন করা হয়। ইন্দোনেশিয়ায় ঈদ উদযাপনের প্রধান ঐতিহ্যবাহী খাবার হলো,‘কেটুপাত’। পাম গাছের পাতায় মোড়া এক ধরনের চালের আটার পিঠা। মাংসের বিভিন্ন আইটেমের সাথে (ওপর আয়াম-নারকেল দুধ দিয়ে রান্না মুরগি অথবা সাম্বাল গোরেং কেনটাং -বিফ এবং আলুর ডিশ) কেটুপাত পরিবেশন করা হয়।

আফগানদের খাদ্যপ্রেমে বোলানি


আফগানিস্তানে ঈদের দিন সকালে বিশেষ যে খাবারটি প্রস্তুত করা হয় তা হল বোলানি।আফগান খাবার বোলানি মূলত আলু,ডাল,কুমড়া ইত্যাদি সবজির পুর দেওয়া ফ্ল্যাটব্রেড। টকদই দিয়ে পরিবেশিত এই খাবারটি কখনো অ্যাপেটাইজার,আবার কখনো মেইনডিশ হিসেবে পরিবেশন করা হয়।ঈদ ও বিশেষ আয়োজন ছাড়াও রমজানে পুরোমাস জুড়ে অনেকে খাবার টেবিলে বোলানি রাখেন।

ইত্তেফাক/এআই

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন