খুনের শিকার নারীর সন্তানকে ৪ লাখ টাকা দেওয়ার শর্তে আসামিকে জামিন দিয়েছিল হাইকোর্ট। শিশুটির সার্বিক কল্যাণের বিষয়টি বিবেচনা করে আসামিপক্ষের দেওয়া এমন প্রস্তাব গ্রহণ করে রমজান ঢালী নামের ঐ আসামিকে মামলার বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত জামিন দেওয়া হয়। খুনের মতো এমন স্পর্শকাতর মামলায় জামিনের বিষয়ে উচ্চ আদালতের এমন ব্যতিক্রমী রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। আগামী ১৫ মে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এ বিষয়ে শুনানির জন্য দিন ধার্য রেখেছেন। ঐ দিন হাইকোর্টের এমন ব্যতিক্রমী রায় কতটুকু আইনসংগত সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ।
২০২০ সালে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ১৩ বছরের পুত্র সন্তানকে নিয়ে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন আমেনা নামের এক নারী। এ সময় দুই সন্তানের জনক রমজান নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে তার। ঐ বছরের ২১ মার্চ আমেনাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন আসামি। ঘটনার দুই দিন পর নিহতের ভাই আইয়ুব খিলগাঁও থানায় মামলা করেন। ঐ দিনই আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরদিনই খুনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তিনি। ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। গত বছরের ১৩ জানুয়ারি আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয় ঢাকা মহানগর দ্বিতীয় অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত। বিচারিক আদালতে কয়েক দফা জামিন চেয়ে ব্যর্থ হন। পরে হাইকোর্টে জামিন চান। আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের বক্তব্য গ্রহণ করে বিচারপতি মো. বদরুজ্জামান ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলনের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত মাসে আসামির জামিন মঞ্জুর করে।
যেসব যুক্তিতে জামিন মঞ্জুর
জামিন মঞ্জুরের রায়ে হাইকোর্ট বলেছে, আমেনা খুনের প্রত্যক্ষদর্শী কোনো সাক্ষী নেই। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণ ও আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর মামলাটি নির্ভর করছে। অভিযুক্ত আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন যে, তার দুটি সন্তান রয়েছে। ভিকটিমের সঙ্গে আড়াই মাস ধরে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ঘটনার দিন ভিকটিম তাকে বিয়ে করতে চাপ দেয়। এ নিয়ে সৃষ্ট মনোমালিন্যের একপর্যায়ে বালিশচাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। প্রাথমিকভাবে, ফরেনসিক ডাক্তার, ময়নাতদন্তের পরে, মৃত্যুর কারণ শনাক্ত করতে পারেনি এবং রাসায়নিক বিশ্লেষণের রিপোর্ট পাওয়ার পরে মতামত দেয় যে, ‘শ্বাসরোধ করার ফলে শ্বাসকষ্টের কারণে ভিকটিমের মৃত্যু হয়েছে’। আসামির জবানবন্দি থেকে বোঝা যায় যে, ভিকটিমকে হত্যা করার কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল না।
রায়ে আরও বলা হয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৯সি(২) ধারায় বলা হয়েছে, একজন দায়রা জজ বা একজন অতিরিক্ত দায়রা জজ বা সহকারী দায়রা জজ যে তারিখে মামলাটি বিচারের জন্য গ্রহণ করবেন তার ৩৬০ দিনের মধ্যে মামলার বিচার শেষ করবেন। ৩৩৯সি(৪) ধারায় আরও বলা হয়েছে, যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার শেষ না করা যায়, তাহলে জামিন অযোগ্য অপরাধের অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তি দেওয়া যেতে পারে। তাই কোনো আসামিকে বিনা বিচারে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারাগারে আটক রাখা যাবে না।
রায়ে আদালত উল্লেখ করেন, এক্ষেত্রে, বিচারিক আদালত কর্তৃক এই মামলা প্রাপ্তির তারিখ থেকে ৩৬০ কার্যদিবস অতিবাহিত হয়েছে। অভিযুক্ত আসামি তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে রয়েছেন এবং অনিবার্যভাবে, মামলার বিচার কার্যক্রমের সমাপ্তি বিলম্বিত হতে চলেছে। অভিযুক্ত আসামির দীর্ঘ কারাবাস ও বিচারের সমাপ্তির অনিশ্চয়তা বিবেচনা করে, আমরা মনে করি যে, অভিযুক্ত আসামির জামিন ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৯সি(৪) ধারা অনুযায়ী জামিনের সুবিধা পাওয়া উচিত।
রায়ে হাইকোর্ট বলেছে, অভিযুক্ত আসামি রমজান ভিকটিমের নাবালক সন্তানের সুস্থতা ও ভরণপোষণের জন্য ৪ লাখ টাকা প্রদান করতে প্রস্তাব করেছেন। এজন্য তিনি ঐ ছেলের জন্য ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, সদরঘাট শাখায় গত ৯ মার্চ একটি পে-অর্ডার ক্রয় করেন। পাশাপাশি এ বিষয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে আসামি অঙ্গীকার করেছেন যে, যদি বিচারের পর তিনি অভিযোগ থেকে খালাসও পান তাহলে ভবিষ্যতে এই টাকা দাবি করবেন না। হাইকোর্ট বলেন, মামলার রেকর্ড অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদের পর থেকে নাবালক শিশুটি তার মায়ের সঙ্গে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিল। শিশুটির সুস্থতার কথা বিবেচনা করে আমরা অভিযুক্ত আসামির প্রস্তাব গ্রহণ করছি। মামলার বাস্তবতা ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা আসামিকে এই মামলার বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত জামিন মঞ্জুর করছি। এরপরই হাইকোর্ট ইসলামী ব্যাংকের সদরঘাট শাখায় ডিপোজিটকৃত ৪ লাখ টাকা নগদায়ন করে সোনালী ব্যাংক সুপ্রিম কোর্ট শাখায় ঐ নাবালক শিশুর নামে তিন বছরের জন্য একটি সঞ্চয়পত্র কেনার নির্দেশ দেয়। সঞ্চয়পত্রটি তিন বছরে পরিপক্ক হওয়ার পর ঐ শিশু সুদসহ মোট টাকা গ্রহণ করবে বলে রায়ে আদালত উল্লেখ করেন।
উচ্চ আদালতের এই রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। কিন্তু আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতের বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী রায় স্থগিত না করে তা শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। আগামী ১৫ মে এ বিষয়ে শুনানির জন্য দিন ধার্য রয়েছে বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মো. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, আমরা মনে করি, এই রায় আইনসংগত নয়। উচ্চ আদালত তার এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে এই রায় দিয়েছেন।
আসামির আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোতাহার হোসেন সাজু ইত্তেফাককে বলেন, খুনের শিকার নারীর সন্তানের সার্বিক কল্যাণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে হাইকোর্ট জামিন মঞ্জুর করেছে।