শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

গাজীপুরের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র

অপলক চোখ স্বজন খোঁজে প্রতিদিন

আপডেট : ০৫ মে ২০২৩, ০৮:০০

শেষ বয়সে সন্তান আর নাতি-নাতনিদের নিয়ে জীবনের বাকি দিনগুলো আনন্দে কাটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা ছিল তাদের। কিন্তু সন্তানের অবহেলা বাবা-মায়ের সে আশার স্বপ্ন নিভিয়েছে; স্বজনের যত্নের বদলে পেয়েছেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। শেষ পর্যন্ত তাদের ঠাঁই হয়েছে গাজীপুরের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। স্বজনদের অপেক্ষায় প্রতিদিন বিকাল হলেই রুমের বারান্দায় বসে থাকেন তারা। অপলক চোখে স্বজন খোঁজে প্রতিদিনই। কিন্তু কেউই আসে না। জলভরা চোখে তারা জানালেন তাদের কষ্টের কাহিনী।

সন্তানের সংসারে সুখ মেলেনি; এখন এই বৃদ্ধাশ্রমকেই জীবনের অবলম্বন করেছেন রানী আহমেদ। বয়স তার ৭২ বছর। স্বামী ইঞ্জিনিয়ার হেলাল উদ্দিন জার্মান টেকনিক্যালে ইনস্ট্রাকটর ছিলেন। তাদের দুই মেয়ে। স্বামী মারা যান ২০১১ সালে। মেয়ের জামাইয়ের কাছে থাকতেন রানী আহমেদ। এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকছেন ১০ মাস ধরে। রানী আহমেদ বলেন, তার শ্বশুর-শাশুড়ি তাকে অনেক আদর করতেন। তারা মারা গেছেন। এরপর স্বামীও মারা গেছেন। আর মেয়ের জামাই তাকে এখানে রেখে গেছেন। এখানে তার মতো আরও অনেকে রয়েছেন। বুকে চেপে রাখা দুঃখ কষ্টের কথা বলতে চাননি রানী আহমেদ। শুধু এইটুকু বললেন, ছায়াঘেরা এই বৃদ্ধাশ্রম তার কাছে বেহেস্তের মতো। খুব আরামে আছেন তিনি। বৃদ্ধ হওয়ায় আত্মীয়স্বজনদের কাছে বোঝা হতে চাননি তিনি। সেজন্যেই এসেছেন এই বৃদ্ধাশ্রমে।

জীবনের গোধূলীলগ্নে এসে নিজের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে চোখ ভিজে ওঠে মমতাজ বেগমের (৭০)। আঁচলে পানি মুছে আবার স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলতে শুরু করেন ফেলে আসা জীবনের গল্প। তার স্বামী বেলায়েত হোসেন মারা গেছেন। তাদের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরে। তাদের তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। দেড় বছর ধরে এই বৃদ্ধাশ্রমে আছেন। তার স্বামীর গুদাম ঘর ছিল সাতটি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও ছিল। স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলেরা ভাগাভাগি করে সব কিছু নিয়ে গেছে। মা ও বোনদের কিছু দেয়নি। রাজধানীর মিরপুরে ছোট মেয়ের কাছে তিন বছর থেকেছেন। স্বামী মারা যাওয়ার আগে ছেলেদের বলে গিয়েছিল, ‘মাকে দেখাশুনা করিস।’ কিন্তু তারা দেখেনি। বৃদ্ধা মা বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিয়েছেন।

তার মতো বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মুন্সীগঞ্জের জরিনা বেগম (৭৫) জানালেন তার অতীত জীবনের নানা স্মৃতির কথা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, তার এক ছেলে ইতালি থাকেন, আরেক ছেলে ফরিদপুরে। মেয়েও আছে। কিন্তু তার ঠাঁই হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। ১৩ বছর ধরে গাজীপুরের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকছেন তিনি। স্বামী মারা যাওয়ার পর ফরিদপুরের শিবচরের মতিজান বিবির ঠাঁই হয়েছে এই বৃদ্ধাশ্রমে। ২৫ বছর ঘর-সংসার করে এখন তাকে থাকতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। এর আগে তিনি একটি শিশুপল্লিতে চাকরি করেছেন। এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকছেন ২২ বছর ধরে।  বৃদ্ধাশ্রমে থাকা টঙ্গীর জাহানারা বেগমও (৭০) জানান, তার অতীত জীবনের নানা স্মৃতিকথা। তিনি বলেন, তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। স্বামী আরজু মিয়া ২০ বছর আগেই মারা গেছেন। দুই ছেলে ও এক মেয়ে তার। সবার বিয়ে হওয়ার পর যে যার মতো আলাদা হয়ে গেছে। দেড় বছর ধরে এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকছেন তিনি।

সিলেটের কুলাউড়ার মরিয়ম বেগম (৭৫) এখন থাকেন এই বৃদ্ধাশ্রমে। তিনি বলেন, তার কেউ নেই। এর আগে উত্তরায় একটি বাসায় কাজ করতেন। গৃহকর্তা সপরিবারে আমেরিকায় চলে যান। আর কোথাও জায়গা না পেয়ে বৃদ্ধাশ্রমে থাকছেন তিনি।  আত্মীয়স্বজনদের কেউ তাদের কোনো খোঁজখবর নেন না। বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই হয়েছে মিনা ঘোষের (৬৫)। তার স্বামী রিবেন ঘোষ থাকেন পাকিস্তানে। এক ছেলে আছে। সে ঢাকার তাঁতিবাজারে থাকে। গণপূর্তের প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার। তার তিন মেয়েও আছে। কিন্তু সন্তানরা তাকে থাকার জায়গা দেয়নি। দুই বছর যাবত এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকছেন মিনা ঘোষ।

স্বামী মারা যাওয়ার পর এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন লুত্ফা বেগম (৬০)। রামপুরার আনন্দনগরে থাকতেন। তার একমাত্র ছেলেও মারা গেছে। আশ্রয় নিয়েছিলেন ভাইয়ের বাড়িতে। সেখান থেকে ভাবি-ভাতিজারা তাকে বের করে দেয়। কিছু দিন ছিলেন ফুটপাতে। পরে বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই হয়।  বললেন, ‘আমার কেউ খোঁজ নেয় না। তবে এখানে আমি অনেক ভালো আছি।’

ইফতেখার আহমেদ শামীম (৬৯) চিরকুমার। বরিশালের বাবুগঞ্জে তার বাড়ি। ২৭ বছর শিক্ষকতা করেছেন। ইংরেজি শেখাতেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্কুলে গিয়েও ইংরেজি শেখাতেন। বনানীতে এক বন্ধুর সঙ্গে থাকতেন। বন্ধু চলে গেছে আমেরিকায়। এর পর আর কোথাও তার থাকার জায়গা নেই। চাকরি করে যে টাকা উপার্জন করেছেন তা-ও শেষ হয়ে গেছে। আত্মীয়স্বজনরা কেউই তাকে জায়গা দেননি। তার বিত্তশালী এক বোন আছেন, তিনিও কোনো খোঁজখবর নেন না।

এই বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই হয়েছে আলী আকবর দেওয়ানের (৭০)। ফরিদপুরে তার বাড়ি। এক ছেলে ও এক মেয়ে আছেন তার। কেউই তার খোঁজখবর নেয় না।  গাজীপুরের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকা ইয়াকুব আলী শিকদারের বয়স ৭৫ বছর। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেহেন্দিগঞ্জে তার বাড়ি। ছিলেন সৌদি আরবে। ২০০০ সালে দেশে আসেন। ছেলে বারিধারায় থাকে। স্ত্রী-সন্তানরা ইয়াকুবকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এই বৃদ্ধাশ্রমে অনেক ভালো আছেন বলে জানালেন তিনি।

ইত্তেফাক/এমএএম