আবুল লজ্জা ঝেড়ে দুয়ারে পা ছড়ানো বুড়িটাকে বলে, ‘মা, কয়ডা ভাত দিবেন বারে।’ বুড়ি মুখে তৈরি হয়ে বসে থাকা উত্তরটা নির্দ্বিধায় উগড়ে দেয়, ‘ভাত নাই।’
উদোম উঠোনে ভাদ্র মাস কড়কড় করে জ্বলে। আকাশ উপুড় হওয়া তাতানো গরম ভাপে চারদিক ঢেউয়ের মতো থরিহরিকম্প। বুড়ি তো ছায়ায় বসে ঠ্যালা টের পায় না। নাতি বয়েসি কেউ ঘামভেজা ঘামাচি মারে নখের আগায়, আর হিসেব রাখে, পনেরো...ষোলো...। বুড়ির চোখ আবার আরামে মুদে আসে।
অন্য বাড়ির দরোজায় গিয়ে আবুল আবার ভাত চায়, ‘বউ গো, কয়ডা ভাত দেন গো মা।’ একবাক্যে দুইটি সম্বোধন করলেও, পরের বউ অথবা মা একঝলক আবুলকে দেখে নিয়ে উত্তর দেয়, ‘আজ ভাত রান্দিনি কো।’ আবুল আলগোছে সরে পড়ে। আবার হাঁটা ধরে। আবার আগুনের হলকা তার গায়ে হামলে পড়ে। আবুল পাত্তা দেয় না। সে তাতানো মাটির ওপর দিয়ে এগিয়ে যায়।
এ এলাকার কেউ আজ দুপুরে ভাত রাঁধেনি। আরেক বাড়ি থেকে এই দুঃসংবাদটি পায় আবুল। আজ তাদের সমবেত দাওয়াত। আচমকা দূরের কোনো মাইকে ভিনদেশি গান বেজে ওঠে। তুমি, আমি, প্রেম, ভালোবাসা শব্দের সুরেলা আবেশে নারীকণ্ঠ উড়ে আসে। আবুল বাঁশঝাড়ের জংলা পেরিয়ে একটা উদোম প্যান্ডেল দেখতে পায়। সামনে খালি জায়গায় একটা রাজসিক তোরণ। সামনে এক নাবালককে পেয়ে জিগায়, ‘এটি কী হয়?’ নাবালক এক কথায় উত্তর সারে, ‘বিয়া।’
প্যান্ডেলের নিচে ডেকরেটরের চেয়ারে বসে, ডেকরেটরের ফ্যানে দাওয়াতি মানুষজন গরম বাতাস খায়। বাতাসে ঘি-ডালডা-মসলার চনমনে সুবাস আবুলের নাকে সুরসুরি মারে। মুখের ভেতর লালা জমে। ধরে রাখতে না পেরে এক ফাঁকে ক্যোঁত্ করে গিলে ফেলে। বড় বড় ডেকচি চুলার ওপরে তপ্ত হয়। বাবুর্চি অনবরত ঘাড়ের গামছায় কপালের ঘাম মোছে। আবুলের পা তার নিয়ন্ত্রণে নেই। সে গটগট করে হেঁটে বাবুচিদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বাবুর্চি খেকিয়ে ওঠে, ‘ওই সর, কে রে তুই?’
আবুল খানিকটা মিনমিন করে বলে, ‘ভাই, দুইডা ভাত চাই।’
‘এ, শালা কয় কী। দাওয়াতি লোক এখনো খায়নি। আর উই খাবার চায়। সর।’
আবুল সরে দাঁড়ায়। সে মনে মনে ছক কষে। সদ্য নামানো বিরিয়ানির ঘ্রাণে সে দিকবিদিক হয়ে যায়। আহ! কয়দিন সে না-খাওয়া। কতকাল সে বিরিয়ানি খায়নি। মারুক আর কাটুক, আজ সে খাবেই। খাবারের ঘ্রাণে আবুলের খিদা বেড়ে যায়। মাইক ফুঁড়ে বের হয়ে আসা হিন্দি গানের সুরেলা ঝংকার আর সমাগমের কিচিরমিচির জায়গা সরগরম করে রাখে। বর আসনে রুমালে লজ্জাঢাকা খ্যাত বংশের সুদর্শন বর টোপরের নিচে ঘামে ভিজে চিকচিক করে। কাজী এখনো আসেনি। বরপক্ষের কেউ কেউ কন্যাপক্ষের এহেন অব্যবস্থাপনায় গজগজ করে। কয়েকজন মিলে কাজীকে ফোন দিয়েও লাভ না হওয়াতে মেজাজি হবু শ্বশুর তার খোঁজে লোক পাঠায়। লোক মারফত খবর আসে কাজী আসছে। বর অতিরিক্ত খুশি হয়ে ওঠে। আবুল তামশাগুলো দেখে। এই মুহূর্তে তার শুধু পেটের চিন্তা। ডেকচি নামিয়ে বাবুর্চি ফ্যানের তলায় আরাম করে বসে। আবার আবুল তার নজরে ধরা খায়। ‘শোন, সবার খাওয়া না হলি খাবার পাবু না। খাবার বাঁচলে তারপর। বরযাত্রী হিসাবের চাইয়া বেশি আচ্চে।’ কথাটা শুনে আবুল বিমর্ষ হয়। সে কল্পনা করে এত স্বাদু স্বাদু খাবার লোকজনে ছড়ায়ছিটায় গবাগব খাচ্ছে। শেষে যারা খাচ্ছে তারা সব আইটেম পাচ্ছে না। আবুল ভাবে। তিনদিন পানি, মুড়ি খেয়ে থাকা আপাত ফকির আবুল হার মানতে চায় না। বিরিয়ানি খাওয়ার সাধ তার মাথায় চড়ে বসে। সে আচমকা বলে বসে বাবুর্চিকে, ‘এই ডেকচির খাবার কয়জন খাবার পাবি?’ বাবুর্চি তিরিক্ষি মেজাজে ঘুরে তাকায়—‘শুনা লাভ কী তোর?’
‘আচে।’
‘ধর, বিশ-পঁচিশ জন।’ আবুল ঢোক গিলে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়। তারপর বেমক্কা বলে, ‘হামি একলাই খাবার পামো।’
‘ফাইজলামি করিস? খাদক হয়া আসিচু?’
‘হ, হামি খাদক।’
বাবুর্চি মেজাজ হারায়। চিত্কার-চেঁচামেচিতে জমায়েত লোকজন ফিরে তাকায়। কয়েকজন ছেলে-বুড়া এগিয়ে আসে। তাদের দেখে আবুল বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। তার চোখে-মুখে সাহস নেচে বেড়ায়। বাবুর্চি বিষয়টি তাচ্ছিল্য নিয়ে সকলকে বলে। কেউ একজন বলে ওঠে, ‘খাবার নিয়া মশকরা করিস না, ভাগ।’
‘মশকরা লয়, হামি খাবার পারমো।’ আবুলের আত্মবিশ্বাস দেখে উপস্থিতি থিতিয়ে আসে। সকলের চোখে তখন আবুল খাদকের রূপে প্রকাশিত হয়। এমন খাদকের গল্প তারা মুরুব্বিদের কাছ থেকে শুনে এসেছে। নাটক-সিনেমায় দেখে এসেছে। বাজি লেগে গামলায় গামলায় ভাত মাংস সাবাড় করে। এরূপ অসম্ভবকল্প ঘটনা চাক্ষুস করে রুমালের আড়াল থেকে বর সংলাপ যোগ করে, ‘না পারলে?’ আবুল নির্ধিদ্বায় উত্তর দেয়, ‘পারমো।’ ততক্ষণে কন্যাপক্ষের মুরুব্বিদল প্রবেশ করে। পবিত্র অনুষ্ঠানের আবহ নষ্ট করার পাঁয়তারা করার জন্য আবুলকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু নেহাতই গরিব মানুষ আর বিয়ের মতো মঙ্গলজনক আনুষ্ঠানিকতায় ঘাড়ধাক্কার মতো অমানবিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার অনুরোধ আসে। তখন শিক্ষিত বর আবার সংলাপ বলে ওঠে, ‘ও কি সত্যি খেতে পারবে?’ সুযোগ বুঝে আবারো একই কথা বলে ওঠে আবুল, ‘পারমো।’
তখন সর্বেসর্বার মতো আধিপত্য নিয়ে বর বলে ওঠে, ‘তাহলে দেখা হোক।’ কন্যাপক্ষ বিরক্ত হলেও, হবু শ্বশুর বিরক্ত হয় না। হবু বরের সিদ্ধান্তের বাইরে আসে না। হবু শ্বশুর জামাইকে উদারতা দেখানোর মওকা হাতছাড়া করে না। শহুরে শিক্ষিত জামাইয়ের বিনোদন বিবেচনায় এবং সময় ক্ষেপণের বাহানা পেয়ে অবস্থাপন্ন শ্বশুর কিঞ্চিত্ খুশি হয়। আবুলের মুখে কাষ্ঠহাসি ফুটে ওঠে। ডেকচিসহ তার সামনে দেওয়া হবে, কোনো প্লেটে নয়। এই শর্তে আবুল রাজি হয়। নতুন আরেক ডেকচি বিরিয়ানি রান্নার ধকল আঁচ করে বাবুর্চি গজগজ করে। ‘খাবার না পারলে কিন্তুক তোক গাছোত ঝোলামো।’ ফাঁকতালে কেউ অপারগতার শাস্তি আগাম ঘোষণা দেয়।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় ছায়ার মতো ক্ষণিক স্থবিরতা নামে। ভিতর বাড়িতে খবরটি ঘ্রাণের মতো তরঙ্গায়িত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। জটলা করে উভয়পক্ষের লোকজন আবুলকে ঘিরে নেয়। জানালার ফাঁকে বিয়ের পাত্রীর মুখ দেখা যায় একঝলক। কনুই পর্যন্ত দুই হাত ধুয়ে এসে শামিয়ানার নিচের ছায়ায় আবুল আল্লার নামে শুরু করে। বাচ্চাকাচ্চা রইরই করে ওঠে। ভাদ্রের কড়কড়ে রোদ্দুরের নিচে অদ্ভুত আদিম এক খেলার দর্শককুল ভুলে যায় স্থানকাল। হালকা ধোঁয়া ওঠা বিরিয়ানির উত্তাপ উপেক্ষা করে আবুল গবাগব গিলতে থাকে। এই অসম্ভব খেলায় সবাই চোখ বিস্ময়ে গোল বানিয়ে তাকিয়ে থাকে। আবুল পেটে বিরিয়ানি চালান করে আর সকলেই তার গ্রাসের হিসাব করতে থাকে বাইশ...তেইশ...চব্বিশ...। মধ্যবয়েসি আবুল বিরিয়ানি আর ভাদ্রের একাকার গরমে তালগোল পাকিয়ে যায়। পানি খেয়ে হালকা দম নিয়ে আরো দুই-তিন লোকমা খাওয়ার পর, যখন ডেকচির বিরিয়ানির দুই-তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট, তখন অসহায়ভাবে সকলের দিকে তাকিয়ে চেহারা কাঁদো কাঁদো বানিয়ে ঘোষণা করে, ‘আর পারমো না বারে।’ এতে সমবেত সকলের গায়ে একসঙ্গে হুল ফোটে। আবুল টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায়। টাল সামলিয়ে ঘুরে বের হতে ধরলে কয়েকটি হাত তাকে থাবা দিয়ে আটকে ফেলে।
‘শালা, খাবার পাবু না তো কলু কিসক?’
‘চুদিরভাই, খাবারগুলান লষ্ট করলু ক্যা?’
কয়েকজনের তেরিমেরি ভাবভঙ্গিতে আবুল ভড়কে যায়। যেন এমন হবার কথা ছিল না। যেন সে হেরে গেলে পরাজয় মেনে নিয়ে ঘাড় কাত করে সহজেই বেরিয়ে আসতে পারবে অনায়াসে। অতিরিক্ত খাবারের ভারে সে আঁকুপাঁকু করে। টেনে টেনে শ্বাস নেয়।
‘হামার খুব খিদা লাগছিল। কয়েকদিন খাইনি।’
‘চাইলেই তো দেয়।’
‘দেয়নি।’
‘বরযাত্রীরা না খাইলে তোক দিবি ক্যাংকা কইরা বে? তোর ধৈর্য নাই? মিচা কতা কলু কিসক?’
আবুল মাথা নত করে ফেলে। কপালের ঘাম চেটো দিয়ে মুছে ফস করে বলে, ‘ভুল হচে।’ কোনো পক্ষের লোক তার ভুল স্বীকারোক্তি গ্রহণ করে না। শুভকাজের ময়দানে খাবার অপচয়ের অপরাধে রোদের মধ্যে আপাতত তাকে বেঁধে রাখার শাস্তি ধার্য করে হবু শ্বশুর। বিয়ের পরে ঘটা করে তার বিচার হবে। কেউ দ্বিমত করে না। অপরিণামদর্শী আবুল এবার তার পরিণাম জানতে পেরে দৌড়ে পালাতে গেলে অতি উত্সাহী কয়েকজনের কিল-ঘুসির আঘাতে ধরাশায়ী হয়, এবং চর্বিত, আধা চর্বিত লালা মিশ্রিত খাবার গলগলিয়ে বেরিয়ে এসে তার পেটটা হালকা করে দেয়।
‘পানি...পানি..., মিচ্চিএনা পানি দেন বারে। কইলজা শুকা গেল।’
বিয়েবাড়ির খাবার মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে অপচয়ের অপরাধে ভাদরের আগুন রোদের তলে খুঁটি বাঁধা, খরার কবলে পড়া প্রান্তিক আঁধিয়ার, আপাত অপেশাদার ফকির আবুল চিঁউচিঁউ করে পানি চায়। অনতিদূরে শামিয়ানার ছায়ার নিচে বিয়ের উভয়পক্ষ মোনাজাতে শামিল। নবদম্পতির মঙ্গল কামনায় আল্লার নিকট দোয়ার গুঞ্জনে আবুলের আর্তি কারো কর্ণে পৌঁছায় না। সবাই তার কথা ভুলে যায়। আবুলের চোখ উলটে আসে। ঠোঁটের কোণা দিয়ে গ্যাঁজলা বের হতে থাকে। সে একটা বিভ্রমের মধ্যে চলে যায়। চারপাশের পার্থিব যাবতীয় শব্দ শ্রাব্যসীমার বাইরে চলে যায়। মানুষগুলো ঢ্যাংগা ঢ্যাংগা গাছে রূপান্তরিত হলে সে দেখে অচেনা এক বনভূমির মাঝে দাঁড়িয়ে তার থুত্থুরি বুড়ি মা তাকে হাতছানি দেয়। তার হাতে ভাতের থালা। ডেকচি, হাঁড়ি থেকে ভাতের ধোঁয়া ওঠে। আশেপাশে ছড়ানো ছিটানো হরেক কিসিমের ফলফলাদি। মা তাকে আঁচলের ছায়ার তলে ডাকে। সে তার মায়ের আঁচলের ছায়ার তলে গিয়ে গবগবিয়ে ভাত খায়। তার পেটে খুব খিদা।
বিয়েবাড়ির মানুষগুলো কেউ তার অস্তিত্ব অনুভব করে না।
লেখক : বিটিভিতে কর্মরত