‘দ্যা প্রবেশন অব অফেন্ডারস’ আইনটি ৬৩ বছরের পুরানো। এই আইনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল কতিপয় মামলায় দণ্ডিতদের শর্তাধীনে মুক্তিদান করা। যাতে তারা কারাগারে না গিয়ে শর্তসাপেক্ষে বাড়িতে থেকে আদালতের শর্ত মোতাবেক নিজেদের সংশোধনের সুযোগ পান। অচল এই আইনটিকে কার্যকর করতে চার বছর আগে দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের নির্দেশনা দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট।
ঐ নির্দেশনায় বলা হয়েছিল ইচ্ছাকৃতভাবে এই আইনের বিধানাবলি প্রয়োগ না করলে তা অসদাচরণের শামিল হবে। বিচারকদের এমন হুঁশিয়ারি দিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত হতে সার্কুলার জারি করলেও তা প্রতিপালনে সচেষ্ট নন অধিকাংশ বিচারক। তবে অধস্তন আদালতের অনেক বিচারক পুরানো এই আইনের বিধানাবলি প্রয়োগ করে বিচার ব্যবস্থায় নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন। এতে বিচারপ্রার্থীরা যেমন উপকৃত হচ্ছেন, তেমনি কারাগারে বন্দির চাপ কমছে।
এখন দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকরা যেন তাদের এক্তিয়ার অনুযায়ী উপযুক্ত মামলায় ৬৩ বছরের পুরোনো এই আইনের আরও কার্যকর প্রয়োগ ঘটান সেজন্য তাদের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে হাইকোর্ট। জানুয়ারি মাসে উচ্চ আদালতের দেওয়া এই নির্দেশনা যেন বিচারকরা প্রতিপালন করেন সেজন্য বৃহস্পতিবার পুনরায় আরেকটি সার্কুলার জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট। ঐ সার্কুলারে বলা হয়েছে, ‘দ্যা প্রবেশন অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স’-এর বিধান প্রতিপালনের জন্য হাইকোর্ট যে আদেশ দিয়েছেন তা প্রতিপালন করতে অধস্তন সব আদালতের বিচারকদের নির্দেশ দেওয়া হলো।
প্রসঙ্গত ‘মো. আসাদ উদ্দিন বনাম বাংলাদেশ’ মামলায় বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চের দেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে বলা হয়েছে, প্রবেশন অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স-এর ৫ ধারায় উপযুক্ত অধস্তন আদালতগুলোকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তার চর্চা করতে বিচারকদের নির্দেশ দেওয়া গেল।
চার বছর আগে দেওয়া নির্দেশনায় যা বলেছিল সুপ্রিম কোর্ট :
সার্কুলারে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় প্রায় সর্বক্ষেত্রেই দণ্ডিতদের সাজা ভোগের নিমিত্তে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। এতে কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত বন্দির সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়াসহ দেশের প্রচলিত আইনের বিধানকে সরাসরি অবজ্ঞা করা হচ্ছে। ফলে কারাগারের পরিবেশসহ সমাজে এক নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হতে চলেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স আইনটির বিধানাবলির যথাযথ প্রয়োগ দরকার। তাই অপরাধীর বয়স, পূর্বাপর আচরণ, দৈহিক ও মানসিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে উপযুক্ত আইনের বিধানাবলির যথাযথ প্রয়োগ পরিস্থিতি উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
সুপ্রিম কোর্টের এই সার্কুলার অনুযায়ী অধস্তন আদালতের অনেক বিচারক এই আইনের বিধানাবলির প্রয়োগ করে নানা মানবিক আদেশ দিতে থাকেন। যা বিচারাঙ্গনসহ বিচারপ্রার্থীদের মনে আশার সঞ্চার জোগায়। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আদালতের নির্দেশে বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ৫ হাজার আসামি প্রবেশনে রয়েছে। যেমন গত পহেলা মার্চ আট বছরের সন্তান হত্যা মামলায় মা স্বপ্না বেগমকে ১০ বছর কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানার রায় দেন লক্ষ্মীপুর জেলা ও দায়রা জজ মো. রহিবুল ইসলাম। তবে দণ্ডিত ঐ নারীকে কারাগারে পাঠানোর পরিবর্তে নিজ বাড়িতে থেকে তার আরেক সন্তান সাব্বিরকে দেখভালের আদেশ দেওয়া হয়। এদিকে লুঘু অপরাধে দুই বছর আগে ৫০টি মামলায় ৭০ শিশুকে সাজা না দিয়ে ছয়টি শর্তে বাবা-মায়ের জিম্মায় দেয় সুনামগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. জাকির হোসেন। শর্তগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: বাবা-মায়ের সেবা-যত্ন করা, অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করা, মাদক থেকে দূরে থাকা ও ভবিষ্যতে কোনো অপরাধে না জড়ানো। এছাড়া রাজশাহীর সিনিয়র জুডিশিয়াল মাজিস্ট্রেট মো. সাইফুল ইসলাম, চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরিফুল ইসলাম, সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজীব কুমার দেব, ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইন, মাগুরার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জিয়াউর রহমান, কক্সবাজারের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী বিভিন্ন মামলায় অপরাধীদের অপরাধ প্রমাণের পর সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানোর পরিবর্তে নানা শর্তে সংশোধনের সুযোগ দেন।
বিচারাঙ্গনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফৌজদারি আদালতের বিচারকরা যদি পুরোনো এই আইনের বিধানাবলি প্রয়োগে আরো আন্তরিক হন তাহলে প্রথমবার যারা লুঘু অপরাধ করে দণ্ডিত হয়েছেন তারা নিজেদের নানা শর্তে কারাগারের বাইরে সংশোধনের সুযোগ পাবেন। কারণ সাজা প্রদানের অন্যতম উদ্দেশ্য সংশোধনমূলক, প্রতিহিংসামূলক নয়।