বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ’মোখা’র প্রভাবে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে কক্সবাজারের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ সেন্টমার্টিন এবং উপকূলীয় টেকনাফ এলাকার। সরকারি হিসাবেই কক্সবাজারে বিধ্বস্ত হয়েছে ১০ হাজারের বেশি ঘর-বাড়ি। উপড়ে গেছে কয়েক হাজার গাছপালা। সেন্টমার্টিনে ৮০ শতাংশ কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসময় সাগরের জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায় সেন্টমার্টিনের একাংশ। সেখানে ঘরবাড়ি, গাছপালা, বিদ্যুতের খুঁটিসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উপড়ে পড়ে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান রবিবার (১৪ মে) সন্ধ্যা ৬টায় জানান, কোন মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। আবহাওয়া বিশ্লেষকরা জানান, বিশাল অবয়বের সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ প্রলয়ংকরী তীব্রতা নিয়ে উপকূলভাগে উঠে আসার সময় সাগরে ছিল ভাটা। ফলে তার সাগর মন্থনের তেজ কমে যায়। জলোচ্ছ্বাস এবং ঘূর্ণাবর্তের ক্ষমতা হ্রাস পায়। এরইমধ্যে ‘মোখা’র কেন্দ্র বাঁক খেয়ে রাখাইন রাজ্যের সিত্তে বন্দর দিয়ে ডাঙ্গায় ওঠে। ফলে ঘূর্ণিঝড়ের মূল আঘাত ছিল মিয়ানমারে। সেখানে ১০ ফুটের বেশি জলোচ্ছ্বাস এবং ২০৯ কিলোমিটার গতিতে ঝড়ের তান্ডব চালিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে মোখা। রাখাইন রাজ্যে ৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। রাত ৯ টার পরে মোখা মিয়ানমারে স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে।
আবহাওয়া দফতর জানায়, সেন্ট মার্টিনে ১৪৭ কিলোমিটার বেগে ‘আঘাত’ হানে ‘মোখা’। দেশের অন্য উপকূলবর্তী জেলাগুলোতে এর বিশেষ প্রভাব পড়েনি। তবে সামান্য বৃষ্টিপাত ও জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বৃদ্ধি পায়। সুন্দরবন এলাকায়ও তেমন প্রভাব পড়েনি।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো.আবদুর রহমান বলেন, ‘মোখা’ কক্সবাজার অতিক্রম করতে ৯ ঘণ্টা সময় নিয়েছে। সকাল ৯টা থেকে শুরু হয়ে অতিক্রম শেষ হয় সন্ধ্যা ৬টায়। ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ টেকনাফ থেকে ৫০-৬০ কিলোমিটার দূরত্বে দক্ষিণ মিয়ানমারের সিত্তে অঞ্চল দিয়ে যায়। এর ফলে শুরু থেকে ‘মোখা’ নিয়ে আমাদের যে ঝুঁকির আশঙ্কা ছিল তা কেটে যায়।
আমাদের কক্সবাজার প্রতিনিধি সায়ীদ আলমগীর ও টেকনাফ প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম জানান, অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র প্রভাবে ঝড়ের তীব্রতায় উড়ে গেছে ঘরবাড়ির চালা। উপড়ে গেছে গাছগাছালি। গাছ পড়ে দুইজন নিহতের খবর প্রচার পেলেও সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ এর সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে গাছ পড়ে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান।
এদিকে ১৪০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার বেগে বাতাসের তান্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাড়ি-ঘর। বাতাসের তীব্রতায় দু’শতাধিক কাঁচাবাড়ি উপড়ে গেছে। চালা উড়ে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরো দেড় শতাধিক ঘর, এমনটি দাবি করেছেন সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নুর আহমেদ। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস ঘোষণার পর হতে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে বাণিজ্যিক কোন পণ্য আনা নেয়া হয়নি। তাই দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে দ্বীপে খাদ্য ও চিকিত্সা সংকট দেখা দিতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। তবে উপজেলা প্রশাসন বলেছে, ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণে কয়েকদিন সময় লাগবে। আগে থেকে প্রস্তুতি থাকায় খাদ্য সংকট হবে না।
সেন্টমার্টিনের মতো লণ্ডভণ্ড না হলেও, টেকনাফ সদর, সাবরাং, হ্নীলা, হোয়াইক্যং, শাহপরীরদ্বীপ উপকূল প্লাবিত হয়েছে। ভেঙেছে গাছগাছালি। এতে অনেক সড়ক-উপসড়কে চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। ‘মোখা’র প্রভাবে বাতাসের তীব্রতায় উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রায় ৪ শতাধিক বসতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি করেছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। ক্ষতিগ্রস্তদের বিভিন্ন লার্নিং সেন্টার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাখা হয়েছে। নষ্ট হওয়া ঘরগুলো সংস্কারের জন্য ইউএন এজেন্সিগুলো কাজ করছে।
এদিকে কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও অন্য উপকূলে ‘মোখা’র প্রভাব তেমন পড়েনি। তবে কিছু কিছু এলাকায় বাতাসে গাছের ডাল-পালা ভেঙ্গে পড়েছে। এতে আহত বেশ কয়েকজন কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিত্সা নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আশিকুর রহমান। কক্সবাজার আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. আবদুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগ ১৪০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার বেগে সেন্টমার্টিন হয়ে মিয়ানমারের দিকে অগ্রসর হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পরও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বলবত্ আছে।
ট্যুরিস্ট পুলিশ সেন্টমার্টিন জোনের দায়িত্বে থাকা সহকারী উপ-পরিদর্শক মাহফুজ বলেন, ‘মোখা’র প্রভাবে তীব্র দমকা ঝড়ো হাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয়রা আগে থেকে আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করায় জানমালের ক্ষতি রোধ সম্ভব হয়েছে। তবে অনেক বাড়ি-ঘর ক্ষতি হয়েছে বলে এলাকার লোকজন জানিয়েছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান বলেন, এখন বাতাসের প্রকোপ কমে এসেছে। সেন্টমার্টিন ও টেকনাফের সাবরাংসহ কিছু এলাকায় গাছ ও ছোট ছোট ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। লোকজন আশ্রয় কেন্দ্রে ছিল বলে কোন প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। এখন আমরা মাঠ পর্যায়ে যাচ্ছি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করে পরে বিস্তারিত জানানো হবে।
মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ ইয়াছিন বলেন, মহেশখালীতে বাতাসের তিব্রতা বেশি হলেও জলোচ্ছ্াস ছিল না। ফলে বড়ধরনের কোন ক্ষতি হয়নি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’য় প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার ঘরবাড়ি আংশিক এবং দুই হাজার কাঁচাঘর সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়ায় হতাহতের কোন ঘটনা ঘটেনি। কোথাও কোন খাদ্য সংকট হবে না। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করতে কিছুটা সময় লাগবে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. আবু সুফিয়ান বলেন, ‘মোখা’র তীব্রতাতেও বেশ কিছু সংখ্যক পর্যটক কক্সবাজারে অবস্থান করছিল। আমরা তাদের দেখভাল ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে সংশ্লিষ্টদের সচেষ্ট রেখেছিলাম। দুর্যোগ এড়াতে পর্যটন এলাকাতেও ৬৮টি হোটেলকে আশ্রয় কেন্দ্র ঘোষণা করে সেখানে দুর্গতদের রাখা হয়। জেলার ৬৬৮ টি আশ্রয় কেন্দ্রে দুই লাখের অধিক মানুষ আশ্রয় নেয়। সবাইকে সাধ্যমতো খাবার সংস্থান করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা সেন্টমার্টিন নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমরা আজকে (রবিবার) রাতও অবজারভেশনে থাকবো। বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে প্রশাসনের সমন্বয় হয়েছে। যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, সেনাবাহিনীর সদস্যরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিবেন।
বিপর্যস্ত চট্টগ্রামের নগরজীবন
চট্টগ্রাম অফিস থেকে সালাহউদ্দিন মো. রেজা জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’য় চট্টগ্রাম নগরজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বাসাবাড়ির রান্নাঘর থেকে শিল্প কল-কারখানায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। গ্যাসের অভাবে অনেক কল-কারখানার উত্পাদন বন্ধ হয়ে গেছে। লাইনের গ্যাস না থাকায় ঘরে রান্নাবান্না প্রায় বন্ধই ছিল। ঘরে রান্না না হওয়ায় নগরবাসী ছিল রেস্টুরেন্ট নির্ভর। দিনভর গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। শনিবার রাত ১১টা থেকে মহেষখালীর এলএনজি টার্মিনাল বন্ধের সাথে সাথে চট্টগ্রাম নগরীতেও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। বিষয়টি কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন থেকে নোটিশের মাধ্যমে কল-কারখানায় জানিয়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি গণবিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়। এর জের ধরে গতকাল সকাল থেকেই গ্যাসনির্ভর কল-কারখানার উত্পাদন আর সচল করা যায়নি। গত শনিবার কিছু গ্যাস স্টেশন চালু দেখা গেলেও গতকাল রবিবার সকল গ্যাস স্টেশন বন্ধ দেখা যায়। ফলে নগরীতে সিএনজি চালিত গণপরিবহন অনেক কমে যায়। একইসাথে সিএনজি চালিত অন্যান্য যানবাহনও সড়কে কম দেখা যায়।
প্রধানমন্ত্রীর নেক আমলের কারণে ‘মোখা’ থেকে রক্ষা: প্রতিমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেক আমল ও পরহেজগারিতার কারণে মোখা বাংলাদেশে প্রভাব ফেলতে পারেনি বলে মন্তব্য করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। তিনি বলেন, যে দেশের সরকার প্রধান পরহেজগার সে দেশে আল্লাহর একটা রহমত থাকে। গতকাল বিকেলে সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
এনামুর রহমান বলেন, অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ ইস্যুতে কক্সবাজারকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হলেও, বিচে গিয়ে সেলফি তুলতে দেখা গেছে অনেককে। এ নিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে ফোন করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ফোনে আমাকে বলেছিলেন, এখনো বিচে মানুষ সেলফি তুলছে, আনন্দ করছে, এটাকে তোমরা নিয়ন্ত্রণ করো। আমরা সেটা দেখে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারের (পিএসও) সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি এরপর বিজিবি, ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌপুলিশসহ সবাইকে নির্দেশনা দিয়েছেন এবং সবার প্রচেষ্টায় তাদেরকে হোটেলে ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছি।
মিয়ানমারে নিহত ৩
ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র আঘাতে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন প্রদেশে অন্তত তিনজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। অ্যাসোসিয়েট প্রেস বলেছে, রাখাইনে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে অনেক ভবনের ছাদ উড়ে গেছে ও অন্তত তিনজনের প্রাণহানি ঘটেছে। শক্তিশালী এ ঝড়ের তান্ডব থেকে বাঁচতে লক্ষাধিক মানুষ মঠ, প্যাগোডা ও স্কুলগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের আবহাওয়া বিভাগ বলেছে, সিত্তে শহরের কাছে ঘণ্টায় ২০৯ কিলোমিটারের বেশি বাতাসের গতিবেগে নিয়ে আছড়ে পড়ে ‘মোখা’র অগ্রভাগ।