শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ঘূর্ণিঝড় মোখা

আপডেট : ১৫ মে ২০২৩, ১৩:৩৫

ঘুর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবে টেকনাফ ও দেশের একমাত্র প্রবাল সমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিনসহ উপকূল এলাকাসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৩ হাজারের মত ঘর-বাড়ি ও ২ হাজারের উপরে গাছপালা সহ শতাধিক পানের বরজ ও ফসলি ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

রোববার (১৪ মে) দুপুর ২টা থেকে বিকেল সোয়া ৫টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টার তাণ্ডব চালায় ঘুর্ণিঝড় ‘মোখ’। দ্বীপে অন্তত চার শতাধিক নারকেলগাছসহ অন্তত কয়েক হাজার গাছগাছালির ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ে আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। জলোচ্ছ্বাসে দ্বীপটির উত্তর পাড়া, পশ্চিম পাড়া ও পূর্ব দিকের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় শুরুর আগে দ্বীপের ৩টি সাইক্লোন শেল্টার ও চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ৩৭টি হোটেল-রিসোর্ট-কটেজে স্থানীয় প্রায় ৭ হাজার বাসিন্দাকে সরিয়ে আনা হয়েছিল। যাদের বেশির ভাগই শিশু ও নারী। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব থামার পর অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়িতে ফিরে যান। তবে, ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলোর সদস্যরা স্বজনদের কাছে বা আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছেন।

কক্সবাজারে গাছ উপড়ে সড়কে পড়ে যোগাযোগ বন্ধ। ছবি: ইত্তেফাক

মোখার তাণ্ডবকে ১৯৯১ সালের ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে শক্তিশালী দাবি করে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, মোখা যখন দ্বীপ অতিক্রম করছিল, তখন সাগরে ভাটা চলছে। মরা কাটাল থাকায় জোয়ারের উচ্চতাও কম ছিল। ভরাকাটাল আর জোয়ার থাকলে ১৮০ থেকে ১৯০ কিলোমিটার গতির মোখা ভিন্ন এক পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারতো।

চেয়ারম্যান মুজিব বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার সম্ভাব্য ভয়াবহতা নিয়ে শুরু থেকে প্রচারণা চালানোয় দ্বীপের বাসিন্দারা আতঙ্কে ছিলেন। ব্যাপক প্রচারণার ফলে দ্বীপের অধিবাসী প্রায় সাত হাজার বাসিন্দা আগেভাগে আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠেন। গত কয়েক দশকের একাধিক ঘূর্ণিঝড়ে এতো মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠতে দেখিনি।

ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ করে ইউপি চেয়ারম্যান মুজিব বলেন, প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি দ্বীপে, সেন্টমার্টিনে প্রায় সাড়ে ৯শ' কাঁচা ঘরবাড়ি ও তিন শতাধিক টিনের আধা পাকা বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে সাতশটি কাঁচা ও ৪০টি টিনের ঘর সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। পুরো দ্বীপে চারশতাধিক নারকেলগাছ উপড়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়েক হাজারের মতো বিভিন্ন গাছগাছালি। কয়েক কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গৃহহীনদের মাঝে অনেকে স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে তাদের দ্রুত পুনর্বাসন করতে হবে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি কামনা করেন।

ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে কক্সবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত এক বাড়ি। ছবি: ইত্তেফাক

নাফ নদীর তীরবর্তী জালিয়া পাড়ার বাসিন্দা জমির উদ্দিন বলেন, প্রশাসনের কথা ঘূর্ণিঝড় শুরুর আগেই পরিবার নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যায়। বিকেলে ঝড় শেষে ফিরে দেখি, তছনছ হয়েছে ঘরবাড়ি। এখন কোথায় আশ্রয় নেবো বুঝতে পারছি না।

ঘূর্ণিঝড়ে, সেন্টমার্টিন, টেকনাফ সদর, পৌর এলাকা, সাবরাং, ডেইলপাড়া, জাদিমুড়া, কোনারপাড়া ও গলাচিপা, বাহারছরা, হোয়াইক্যং, শাহপরীরদ্বীপ এলাকায় প্রচুর গাছপালা এবং ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। উড়ে গেছে ঘরের চাল।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ১২ শতাধিক ঘরবাড়ির কয়েক হাজার মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন। এদের মাঝে যারা স্বজনদের বাড়ি যেতে পারেননি তারা আপাতত আশ্রয়কেন্দ্রেই থাকবেন। ঘর মেরামতের পর নিজেদের ঘরে উঠতে পারবেন।

দ্বীপে সাবেক চেয়ারম্যান নুর আহমেদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়ে সবাই আতঙ্কগ্রস্ত ছিলাম। গত ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময়ও দ্বীপের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে প্রচারণা হয়। কিন্তু সিত্রাংয়ের তেমন প্রভাব পড়েনি। কিছু গাছ ও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এবারের ঝড়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকায় তাণ্ডবও চলেছে সেন্ট মার্টিনে। এর সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস হলে পুরো দ্বীপ লন্ডভন্ড হয়ে যেত। আল্লাহর রহমত ছিল বলে ক্ষয়ক্ষতি সেভাবে হয়নি।

ঘূর্ণিঝড়ে জেলার ক্ষয়ক্ষতির কথা জানিয়ে জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, জেলার ৫৭ ইউনিয়ন ও তিনটি পৌরসভা দুর্যোগ কবলিত হয়েছে। এসব এলাকার তিন লাখ ৩৪ হাজার ৬২০ দূর্গত লোকজনের ১০ হাজার ৬৬৯ ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতি হয়েছে। আর পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুই হাজার ২২টি ঘর। সবচেয়ে বশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেন্টমার্টিন। এই দ্বীপের প্রায় এক হাজার ২৫০ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাশাপাশি বেশ কয়েকজন আহত হলেও নিহতের খবর পাওয়া যায়নি।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে টেকনাফ ও কক্সবাজারে অনেক গাছপালা উপড়ে পড়েছে। ছবি: ইত্তেফাক

জেলা প্রশাসক জানান, জেলায় দুই লাখ ৩৭ হাজার ২৪১ জন উপকূলবাসী জরুরি আশ্রয়ে শেল্টারে আশ্রয় নিয়ে ছিল। তাদের শুকনো ও রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় সতর্ক সংকেত তুলপ নেয়ার পর আশ্রয়ে আশা লোকজন বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করে। সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা নিরাপদে বাড়ি ফিরেছে। তবে যাদের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের আশ্রয় কেন্দ্রে রেখে ঘর মেরামতের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

টেকনাফ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বলেন, আমরা সব বিষয়টি খোঁজ খবর নিতেছি। রাস্তায় পড়ে যাওয়া গাছপালা ও বৈদ্যুতিক কুটি সরানোসহ মানুষকে নিরাপদে রাখাসহ খাদ্য সামগ্রী ব্যবস্থার প্রয়োজনী কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।

তিন ঘণ্টার তাণ্ডব চালায় ঘুর্ণিঝড় ‘মোখ’।ছবি: ইত্তেফাক

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (যুগ্ম সচিব) মো. মিজানুর রহমান বলেন, ঘুর্ণিঝড় মোখার আঘাতে ক্ষতি হওয়া বসতি সংস্কার করার জন্য এনজিও সংস্থা ও ভলেন্টিয়ারসহ ক্যাম্পের দায়িত্বরত সিপিসি সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের সহযোগিতা করা হচ্ছে।

ইত্তেফাক/আরএজে