সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৯ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়ে কী হচ্ছে?

আপডেট : ১৭ মে ২০২৩, ০২:৪৪

সরকারি কলেজের শিক্ষকদের পদন্নোতি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে দীর্ঘদিনের বন্ধ্যাত্বে নব্বইয়ের দশকে সরকারি কলেজের প্রভাষকদের নিয়ে প্রথমে সরকারি কলেজ প্রভাষক সমিতি এবং পরে সরকারি কলেজ অধ্যাপক সমিতি গঠিত হয়েছিল। লেখক এই সমিতির সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত ছিল এবং খুলনা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল। সেই সময় সরকারি কলেজের শিক্ষকদের দ্রুত পদোন্নতিসহ অনেকগুলো দাবি ছিল। দাবিগুলোর মধ্যে একটি ছিল প্রশাসন ক্যাডারের ধাপগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে শিক্ষা ক্যাডারেও ছয়টি ধাপ থাকতে হবে, যেমন—সহকারী অধ্যাপক, সিনিয়র সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, যুগ্ম অধ্যাপক, অতিরিক্ত অধ্যাপক এবং অধ্যাপক। আরেকটি দাবি ছিল—প্রতিটি মন্ত্রণালয় নিজ নিজ ক্যাডার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। যেমন—শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রিত হবে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা দ্বারা। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু হলেও কোনো সরকারই আমলানির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বিধায় অধ্যাপক সমিতির সময়মতো পদোন্নতিসহ কিছু দাবি পূরণ হলেও উল্লেখিত দাবি দুটিসহ অধিকাংশ দাবি ৩০ বছরেও পূরণ হয়নি। প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে অন্য ২৮ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সান্ত্বনা হিসেবে সচিবালয়ের মোট উপসচিব থেকে তদূর্ধ্ব পদের মাত্র ৩০ শতাংশের জন্য প্রবেশ পদ উপসচিব পদে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ প্রদানের প্রথা বিদ্যমান আছে। তবে সমস্ত নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রশাসন ক্যাডারের সিনিয়র কর্মকর্তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন। অনেক সময় আবার ক্যাডার পরিবর্তনের আবেদন বিজ্ঞপ্তিটি গোপনে প্রচার করা হয় বিধায় আগ্রহী প্রার্থীরা জানতে পারেন না। ফলে ক্যাডার পরিবর্তনের সুযোগটি কেবল প্রশাসন ক্যাডারের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডার সবচেয়ে বড় ক্যাডার হলেও ক্যাডার পরিবর্তনে মোট উপসচিব পদমর্যাদার ২ শতাংশের অধিক পদে নিয়োগ পায় বলে মনে হয় না।

দুঃখজনক হলেও সত্য, শিক্ষা ক্যাডার সবচেয়ে বড় ক্যাডার হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে একদিকে যেমন প্রশাসন ক্যাডারের প্রতিহিংসার শিকার, অন্যদিকে তেমনি রাজনীতির শিকার। শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বদলি এবং প্রেষণে সম্মানজনক ও গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই, থাকলে হয়তো তাদের এ ধরনের বহুমুখী হয়রানির শিকার  হতে হতো না। তবে এটাও ঠিক, যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, সেই দল চায় প্রশাসন ক্যাডারের মতো শিক্ষা ক্যাডারেও তাদের আদর্শ ধারণকারী কর্মকর্তাদের সম্মানজনক ও গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করতে। এতে দোষের কিছু নেই। এতে সরকারের জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়নের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং বিপরীত নিয়োগে কর্মসূচি বাস্তবায়নে ধীরগতি ও স্যাবোটেজ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার আদর্শগতভাবে সরকারের প্রতি আনুগত্য শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়ার  ব্যাপারেও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। যেমন—গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়ার আগে ইচ্ছুক বা যোগ্য কর্মকর্তার নিজ এলাকার মাননীয় সংসদ সদস্যের ডিও লেটার সংশ্লিষ্ট নিয়োগ কর্তৃপক্ষের  পাঠাতে হবে এবং একাধিক এলাকার একাধিক কর্মকর্তার আবেদনসহ ডিও লেটার থাকলে অবশ্যই তাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে পদায়ন করা উচিত। এ ব্যাপারে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট নিয়োগ কর্তৃপক্ষ ও প্রার্থী কর্মকর্তাদের নিজ এলাকার মাননীয় সংসদ সদস্যের মধ্যে সমন্বয় থাকা জরুরি। কোনো অবস্থাতেই যেন রাজনৈতিক সরকারের নিজ দলের আদর্শবহির্ভূত কোনো কর্মকর্তা নিয়োগ কর্তৃপক্ষ বা মন্ত্রণালয়ের একক সিদ্ধান্তে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগপ্রাপ্ত না হয়, এ ব্যাপারে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। আবার প্রেষণে নিয়োগপ্রাপ্ত অথবা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তাকে তাৎক্ষণিক বদলি করতে হলে কারণ জানিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অবহিত করা উচিত।

আলোচ্য ধারাবাহিকতায়  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়ের মেধাবী ছাত্র ও ছাত্রলীগের অত্যন্ত নিবেদিত কর্মী এবং পারিবারিকভাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণকারী বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের অর্থনীতি বিষয়ের সহযোগী একজন অধ্যাপককে যশোর শিক্ষা বোর্ডে বিদ্যালয় পরিদর্শক পদে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু তাকে কয়েক মাস আগে তাত্ক্ষণিকভাবে যশোর শিক্ষা বোর্ড থেকে বদলি করা হয় এবং তদস্থলে একসময়ের খুলনা সরকারি বিএল কলেজের ছাত্রশিবিরের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত বর্তমানে শিক্ষা ক্যাডারের উদ্ভিদবিদ্যার একজন সহযোগী অধ্যাপককে প্রেষণে পদায়ন করা হয়। বিষয়টি লেখকসহ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনেক মানুষকে হতবাক, বিস্মিত ও ব্যথিত করেছিল। লেখক বিষয়টি অবহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যশোরের কয়েক জন আওয়ামী লীগ নেতা এবং লেখকের একসময়ের ছাত্রদের জানালে তারা বিস্মিত হলেও কার্যকর কোনো ভূমিকা নিতে ব্যর্থ হয়েছিল। অনেক ডাকসাইটে নেতার কাছে গিয়েও এ ধরনের ব্যাপারে শিক্ষা ক্যাডারের অনেকেই দেখা করতে পারছেন না।

বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সব সক্রিয় কর্মীকে চিনতেন এবং পাঁচ-দশ বছর পরে দেখা হলেও নাম ধরে ডেকে কাছে নিতেন। ফলে সেই কর্মীরা বংশপরম্পরায় বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করে রেখেছেন এবং এখনো আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। জননেত্রী শেখ হাসিনাও সারা বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা-কর্মীকে নামে চেনেন। কাজেই আপনার পক্ষে সবকিছু জানা সম্ভব নয়, এই বলে দায় এড়াতে পারেন না। আসলে যশোরসহ সারা দেশের রাজনীতিতে বর্তমানে দু-একজন বাদে সত্যিকারের আদর্শবান, নিবেদিত এবং রাজপথের লড়াকু ও ত্যাগী রাজনীতিবিদ নেই। আওয়ামী লীগের ত্যাগী, আদর্শবান ও জনসম্পৃক্ত অধিকাংশ নেতাই ইতিমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যারা জীবিত আছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতিতে সামান্য ভুল করে অথবা ভুল না করেও কোণঠাসা হয়ে আছেন। কোনো কর্মী বা সমর্থক তাদের কাছ থেকে বিমুখ হয়ে এসেছেন—এমন কোনো ঘটনা লেখকের  জানা নেই। লেখক তাদের কাছ থেকে যে সম্মান পেয়েছেন, তা আজও ভুলতে পারেননি।

১৯৯৬ সালে যশোর-৬ থেকে নির্বাচিত সাবেক মাননীয় সংসদ সদস্য  ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মরহুম এ এস এইচ কে সাদেক এবং ২০০৮ সালে যশোর-২ আসন থেকে নির্বাচিত সাবেক মাননীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক আইসিটি মন্ত্রী মরহুম মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ উভয়ই জাঁদরেল আমলা হলেও তাদেরও জনসম্পৃক্ততা ছিল অসাধারণ। এবার আসি সদ্য ঘটে যাওয়া খুলনার আরেকটি ঘটনা নিয়ে। গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে হঠাৎ করে খুলনা সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষকে বদলি করে মাউশিতে ওএসডি করা হয়। এই প্রফেসর বঙ্গবন্ধুর একজন শতভাগ আদর্শের কর্মকর্তা। তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায়  ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। এমনকি ১৯৮১ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর যেদিন, অর্থাৎ ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সব বাধাবিপত্তি ও প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, সেই দিন তিনি সুদূর বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ থেকে প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে শেখ হাসিনাকে একনজর দেখা এবং তার প্রতিক্রিয়া শোনার জন্য বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়েছিলেন। এমন একজন বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক কর্মকর্তাকে হঠাৎ এভাবে কোনো কিছু না জানিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কেন ওএসডি করা হয়, তা বোধগম্য নয়। এতে খুলনা নগরবাসী ও তার হিতাকাঙ্ক্ষীরা হতবাক, বিস্মিত ও মর্মাহত হয়েছে। শেখ হাসিনার অবর্তমানে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে তাদের বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বারবার পড়ে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী নিজেদের নিয়োজিত করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আসলে বঙ্গবন্ধুর নিকট আত্মীয়দের মধ্যে অনেকে তখন অবদান রেখেছিলেন। শহিদ ফজলুল হক মনি ছিলেন যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তার উত্তরসূরি দুই ছেলে অধ্যাপক শেখ  ফজলে শামস পরশ ও ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস স্বমহিমায় উজ্জ্বল। বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার পুত্র আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কম্পিউটার বিজ্ঞানী সজীব ওয়াজেদ জয় ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশের নেপথ্য রূপকার। কিন্তু বাকিরা কী করছেন?

এবার আসা যাক মূল কথায়। একটি সরকারের দলীয় কর্মকর্তারাই শুধু গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক পদগুলোতে নিয়োগ পাবেন, আমি অবশ্য এর পক্ষপাতি নই। তবে এ ধরনের দলীয়করণ সৃষ্টি হয়েছিল  বিএনপির শাসনামলে। এ বিষয়ে লেখকের চাকরিজীবনের একটি নির্মম অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। লেখক ২০০১ সালের শেষের দিকে যশোর শিক্ষা বোর্ডে উপ-কলেজ পরিদর্শক থাকা অবস্থায় সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদন্নোতি পেয়ে মাদারীপুর সরকারি নাজিমুদ্দিন কলেজে পদায়িত হয়। তখন লেখকের চার মেয়ে যশোরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করায় পরিবার স্থানান্তর করা সম্ভব ছিল না বিধায় একজন আত্মীয় আমলার মাধ্যমে যশোর সরকারি সিটি কলেজে উপাধ্যক্ষ পদে পদায়ন করাতে সক্ষম হলেও যশোরের বিএনপির তৎকালীন মন্ত্রী তৎকালীন শিক্ষা সচিবকে গালাগালি করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদায়নজনিত বদলি বাতিল করে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, বিএনপির দুই শাসনামলে দলীয় কর্মকর্তা ছাড়া অন্য দলের কোনো সমর্থক কোনো গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার সুযোগ পেতেন না। অথচ আওয়ামী লীগের প্রতিটি আমলে বিএনপি-জামায়াতের অনেক সমর্থক কর্মকর্তা বহু গুরুত্বপূর্ণ, সম্মানজনক ও লাভজনক পদে নিয়োগ পেয়ে নির্ভয়ে চাকরি করে আসছেন।

আলোচ্য ঘটনাগুলো বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি খণ্ডিত চিত্র। সারা বাংলাদেশের চিত্র হয়তো আরো মারাত্মক। ফলে সারা বাংলাদেশের আওয়ামীপন্থি শিক্ষক-কর্মকর্তাদের নিজ দলের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে, যা আওয়ামী লীগের জন্য খুবই ক্ষতিকর এবং হয়তো আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে।

লেখক : সাবেক ট্রেজারার, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন