মঙ্গলবার, ৩০ মে ২০২৩, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস আজ

দেশে উচ্চ রক্তচাপের নীরব মহামারি চলছে

আপডেট : ১৭ মে ২০২৩, ০৬:৩২

উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন একটি দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যগত সমস্যা। যা অকালমৃত্যু ঘটায়। বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপ পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এটি বাংলাদেশ নীরব মহামারির মধ্যে রয়েছে। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বাংলাদেশ এনসিডি স্টেপস সার্ভে অনুযায়ী দেশে প্রতি পাঁচ জনে এক জন প্রাপ্তবয়স্ক অর্থাৎ ২১ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। উচ্চ রক্তচাপজনিত অসুস্থতা এবং অকালমৃত্যুর বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যে এনসিডি লক্ষ্যমাত্রা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগজনিত অকালমৃত্যু এক-তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনা সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না।

দেশে এমন পরিস্থিতিতে আজ ১৭ মে বুধবার, বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস-২০২৩ পালিত হবে। দিবসটি উপলক্ষ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এবছর দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে—‘সঠিকভাবে রক্তচাপ মাপুন, নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং দীর্ঘজীবী হোন।’

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের ইপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, রক্তচাপ যদি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেড়ে যায়, তাহলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বলে। রক্তচাপ সাধারণত দুইটি মাত্রা বা সংখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। প্রথম সংখ্যাটি সিস্টোলিক, যা হৃদপিণ্ড সংকুচিত হয়ে রক্তনালিতে যে চাপ তৈরি হয় তার প্রতিনিধিত্ব করে। দ্বিতীয় সংখ্যাটি ডায়াস্টোলিক, যা হৃদপিণ্ডের প্রসারণের সময়ে রক্তনালিতে চাপের প্রতিনিধিত্ব করে। স্বাভাবিক অবস্থায় একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের রক্তচাপের পরিমাপ ১২০/৮০ মি.মি. পারদচাপ ধরা হয়ে থাকে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস যেমন, খাদ্যের সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ (সোডিয়াম) গ্রহণ, স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার এবং তামাক, অ্যালকোহল সেবন উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে থাকে। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে। যেমন শারীরিকভাবে কর্মঠ না থাকা, অতিরিক্ত ওজন, মানসিক চাপ এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল ও শাকসবজি না খাওয়া।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগটির নির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ এবং উপসর্গ থাকে না। রোগী বুঝতেই পারে না যে, তার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। এজন্য উচ্চ রক্তচাপকে নীরব ঘাতক বলা হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সকালের দিকে মাথাব্যথা, নাক দিয়ে রক্ত পড়া,  হৃদপিণ্ডের অনিয়মিত ছন্দ, দৃষ্টিতে পরিবর্তন এবং কানে গুঞ্জনের মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করা না হলে, এটি ধমনি এবং মানবদেহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। ধমনি শক্ত হয়ে  হৃদপিণ্ডে রক্ত ও অক্সিজেনের প্রবাহ হ্রাস পেতে পারে। ফলে বুকে ব্যথা বা অ্যানজাইনা, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইল এবং হার্ট বিট অনিয়মিত হতে পারে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ অর্থাৎ স্ট্রোক এমনকি বিকল হতে পারে।

ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্টস স্কুল অব পাবলিক হেলথ এর অধ্যাপক ডা. মলয় কান্তি মৃধা বলেন, সবশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে দেখা গেছে, ১৮ বছরের বেশি বয়সি ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। ২০৩০ সাল নাগাদ গিয়ে দাঁড়াবে ৩ কোটি ৮০ লাখে। কিন্তু আক্রান্তদের ৬৭ শতাংশ জানে না যে, তাদের রোগটি রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীই (৬৪ শতাংশ) কোনো ওষুধ সেবন করে না। ১৪ শতাংশ মানুষের রোগটি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের মাধ্যমে ৭৬ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা সংশ্লিষ্টরা জানান, উচ্চ রক্তচাপ মহামারি মোকাবিলায় সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বহুখাতভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ২০১৮-২০২৫ তৈরি করেছে। যেখানে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা অনুসরণ করে ২০২৫ সালের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রাদুর্ভাব তুলনামূলকভাবে ২৫ শতাংশ কমানোর জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ ব্যবস্থাপনায় জাতীয় গাইডলাইন এবং এর চিকিৎসায় ন্যাশনাল প্রোটোকল প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদি (২০১৭-২০২২) হেলথ, পপুলেশন অ্যান্ড নিউট্রিশন সেক্টর প্রোগ্রাম (চতুর্থ এইচপিএনএসপি)-এ অসংক্রামক রোগ ব্যবস্থাপনায় উচ্চ রক্তচাপকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান জানান, ‘উচ্চ রক্তচাপ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে গাইডলাইন রয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সম্মিলিতভাবে কাজ করলে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ মোকাবিলা করা সম্ভব।

বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে দেশের জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ এবং মোট জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দ হওয়া উচিত। চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে দেশের স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। যা মোট জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৮৩ শতাংশ। তাই উচ্চ রক্তচাপের মতো অসংক্রামক রোগের প্রকোপ মোকাবিলায় এখাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি তথা টেকসই অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ব্যক্তির ওপর চিকিত্সাজনিত ব্যয়ের বোঝা হ্রাস করা সম্ভব হবে না।    

 

ইত্তেফাক/ইআ