মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বান্দরবানে সেনা টহলে কুকিচিন সন্ত্রাসীদের হামলা দুই সৈনিক নিহত

সেনাপ্রধানের শোক

আপডেট : ১৮ মে ২০২৩, ১১:০২

বান্দরবানের রুমায় সেনাবাহিনীর টহল দলের ওপর সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) হামলা চালায়। এতে সেনাবাহিনীর দুই সৈনিক নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন দুই কর্মকর্তা। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, মঙ্গলবার দুপুরে রুমা উপজেলার সুংসুংপাড়া সেনা ক্যাম্পের আওতাধীন জারুলছড়িপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জারুলছড়িপাড়া  নামক স্থানে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আস্তানার খবর পেয়ে সুংসুংপাড়া আর্মি ক্যাম্প হতে মেজর মনোয়ারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি টহল দল মঙ্গলবার দ্রুততার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্থানে গমনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। উক্ত টহল দলটি জারুলছড়িপাড়ার নিকটস্থ পানির ছড়ার কাছাকাছি পৌঁছালে আনুমানিক দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটে কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) সন্ত্রাসীদের ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) বিস্ফোরণ ও অতর্কিত গুলিবর্ষণের সম্মুখীন হয়। এতে দুই জন অফিসার ও  দুই জন সৈনিক আহত হয়। আহতদের দ্রুততার সঙ্গে হেলিকপ্টারে সিএমএইচ চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা হয়। পরে চিকিত্সারত অবস্থায় আহত সৈনিকদ্বয় মৃত্যুবরণ করে। তারা হলেন, মো. আলতাফ আহম্মদ এবং মো. তৌহিদ। আহত অফিসারদ্বয় বর্তমানে চট্টগ্রাম সিএমএইচ-এ চিকিত্সাধীন রয়েছেন। তারা হলেন সেনাবাহিনীর অফিসার ক্যাপ্টেন ইশতিয়াক আহম্মদ ও মেজর মনোয়ার।

সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ দেশমাতৃকার জন্য আত্মোত্সর্গকারী শহিদ সেনাসদস্যদের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন। পাহাড়ি-বাঙালি নেতারা ঘটনার নিন্দা জানিয়ে সন্ত্রাসীদের নির্মূল করার দাবি তুলেছেন। তারা বলেন, কেএনএ-র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পর বান্দরবানে পাহাড়ি-বাঙালিরা আতঙ্কে রয়েছেন। এই ঘটনায় সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। আমরা শান্তি চাই। সন্ত্রাসীদের নির্মূল করে পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ব্যাপারে সরকার প্রধানের হস্তপেক্ষ কামনা করে পাহাড়ি-বাঙালি নেতারা বলেন, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর থেকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা আর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু দেখতে চাই না।  

রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িসহ দুর্গম পাহাড়ে বর্তমানে জেএসএস (মূল), জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ (মূল) ও ইউপিডিএফ (সংস্কার) এই চারটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয়। এই চার সংগঠনের মূল কাজ চাঁদাবাজি ও মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। বান্দরবানে হত্যা, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির নতুন আতঙ্কের নাম নাথান বম। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অধীনে থাকাটা মানতে পারছে না তারা। তাদের রয়েছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। কোনো কিছু হলেই সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার ও ভারতে তারা আশ্রয় নেয়। জেএসএসের (মূল) এক শীর্ষ নেতার হাত ধরে ও তার প্রশ্রয়ে কেএনএফ প্রতিষ্ঠা করেন নাথান বম। জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের নামে, মোটা অঙ্কের টাকা আয় করার উদ্দেশ্যে, গহিন অরণ্যে প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। জঙ্গি নেতাদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ প্রদানের চুক্তিও স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু সেই কেন্দ্রের প্রশিক্ষণ প্রদান বেশি দিন টিকিয়ে রাখতে পারেননি। র?্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে সেই প্রশিক্ষণ আস্তানা তছনছ হয়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার গহীন অরণ্যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। কুকি-চিনের সন্ত্রাসীরা বান্দরবানে মেতে উঠেছে রক্তের খেলায়। অপহরণ, খুন, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে বান্দরবানের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করছে তারা। এই সন্ত্রাসীরা একদিকে যেমন সেনাবাহিনীর টহল টিমে হামলা করছে, আবার কখনো টাকার জন্য পাহাড়িদের অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। এতে ভয়ে আছেন পাহাড়ি-বাঙালিরা।

প্রসঙ্গত, ৮ মে রোয়াংছড়িতে পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক) এবং মগ লিবারেশন পার্টির (মগ বাহিনী) মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। গত মাসের ৭ এপ্রিল রোয়াংছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের খামতানপাড়া এলাকা থেকে বম জনগোষ্ঠীর আট জনের লাশ উদ্ধার করে যৌথবাহিনী। এরপর ২৭ এপ্রিল রুমা উপজেলার মুয়ালপিপাড়া এলাকা থেকে বম জনগোষ্ঠীর এক জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহতরা সকলেই পাহাড়ের বম জনগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সদস্য বলে জানা গেছে। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ইউপিডিএফ গনতান্ত্রিক-এর সাথে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলি হচ্ছে কয়েকমাস ধরে। গত ১৩ মার্চ সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিনের হামলায় সেনাবাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিনের মৃত্যু হয়। এসময় গুলিবিদ্ধ হয়ে সৈনিক রাকিবুল ইসলাম ও সৈনিক শিশির আহমেদ আহত হন।

পাহাড়ের নতুন সংগঠন কেএনএফ ২০২২ সালের মে-জুন থেকে ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়ন, বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি উপজেলার দুর্গম এলাকার পাহাড়ে তাদের সশস্ত্র তত্পরতা শুরু করে। তারা বম, খুমি,  খেয়াং, লুসাই, ম্রো ও পাংখুয়া এই ছয় জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের জন্য সশস্ত্র আন্দোলন করছে বলে দাবি করে আসছে। ইতিমধ্যে পাহাড়ের অন্য দুটি সশস্ত্র দলের সঙ্গেও কেএনএফের একাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। কেএনএফের সশস্ত্র তত্পরতার কারণে রুমা, রোয়াংছড়ি  ও থানচি উপজেলায় পর্যটক ভ্রমণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকায় থমকে গেছে বান্দরবানের পর্যটন শিল্প। শতাধিক হোটেল-মোটেল রিসোর্টের হাজারো শ্রমিক কর্মহীন অবস্থায় আছে।

ইত্তেফাক/এসকে