সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৯ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি নূতন পারমাণবিক অস্ত্র?

আপডেট : ১৯ মে ২০২৩, ০৬:০০

পৃথিবীতে যুগে যুগে মহাপ্লাবনের মতো প্রযুক্তির ঢেউ আসিয়াছে। আমরা তেমনই একটি ঢেউয়ের মুখে। তাহা হইল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন (এআই) অত্যাধুনিক অ্যাপ্লিকেশন। ইহাকে বলা যাইতে পারে আধুনিক আলাদিনের চেরাগ। আপনি চেরাগে ঘষা দিলেন, দৈত্য বাহির হইল, তাহাকে আদেশ দিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই অনুযায়ী কার্যসিদ্ধি হইয়া গেল। নূতন আলাদিনের চেরাগের নাম হইল ‘চ্যাটজিপিটি’। আলাদিনে দৈত্যের মতো সরাসরি কোনো কিছু বানাইয়া দিতে পারিবে না বটে, তবে যে কোনো গবেষণালব্ধ তথ্য হাজির করিতে পারিবে চ্যাটজিপিটি। ইহা কত বিশাল ব্যাপার, তাহা সম্ভবত এখনো আমরা উপলব্ধি করিতে পারিতেছি না। কী এই চ্যাটজিপিটি? ইহা হইল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কনটেন্ট ক্রিয়েটর। যাহার পুরা নাম—‘জেনারেটিভ প্রি-ট্রেইনড ট্রান্সফরমার’। ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বরে বিশ্বের প্রথম সারির মার্কিন গবেষণা ল্যাবরেটরি ওপেন এআই এই চ্যাটবট বাজারে আনিয়াছে। বলা যায়, চালু হইবার পর সারা বিশ্বে হইচই ফেলিয়া দিয়াছে। চ্যাটজিপিটি সম্পর্কে মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস সম্প্রতি বলিয়াছেন—বিশ্বকে বদলাইয়া দিবে চ্যাটজিপিটি। গেটস মনে করেন—পূর্বের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাগুলি সকল বিষয়ে লিখিতে ও পড়িতে পারিত (অনেকটা তোতাপাখির মতো), কিন্তু বিষয়বস্তু বুঝিত না। কিন্তু চ্যাটজিপিটি বিষয়বস্তুও বোঝে। যেমন—এতদিন আপনি জগত্ সংসারের যাবতীয় হদিশ গুগল ঘাঁটিয়া পাইয়াছেন। যাহা জানিতে চাহেন, গুগল আপনাকে লক্ষ লক্ষ পাতার তথ্য দিয়া সেইগুলি আপনার সামনে উপস্থিত করিয়াছে।

আশঙ্কা করা হইতেছে চ্যাটজিপিটির মাধ্যমে ভবিষ্যৎ চাকুরির বাজার সংকুচিত হইয়া যাইবে। প্রথমত, ইহা নিমেষের মধ্যে প্রোগ্রাম কোড লিখিতে পারে। ফলে, সাধারণ প্রোগ্রামারদের প্রয়োজনীয়তা হয়তো আর তেমন থাকিবে না। দ্বিতীয়ত, কনজিউমার কেয়ার এক্সিকিউটিভদের শনির দশা হইবে। কারণ, চ্যাটজিপিটি ক্রেতার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর ও নির্দিষ্ট পরামর্শ দিতে সক্ষম। তৃতীয়ত, সংবাদ, সমীক্ষা, উত্তর-সম্পাদকীয় লেখার কাজও করিয়া দিতে পারিবে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চ্যাটবট। ইহার প্রখর তথ্যজ্ঞান অবশ্যই ঈর্ষণীয়। চতুর্থত, চ্যাটজিপিটির লেখার গুণমান ও ব্যাকরণ-জ্ঞান এতটাই সমৃদ্ধ যে আইনি নথি ও দলিল-দস্তাবেজ তৈরিতেও ইহা পুরোপুরি সক্ষম। এই সম্পাদকীয় লিখিবার সময় আমরা চ্যাটজিপিটিকে প্রশ্ন করিলাম—তুমি কি মনে করো মানবসভ্যতার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হুমকিস্বরূপ? চ্যাটজিপিটি যাহা বলিল, তাহার সারাংশ হইল—ইহার সম্ভাব্য বিপদগুলি লইয়া বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্ক রহিয়াছে। যদিও এই প্রযুক্তি মানবসমাজে অনেক সুবিধা এবং অগ্রগতি আনয়নের বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি করিবে। তবে বিপদের মধ্যে রহিয়াছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অটোমেশন প্রযুক্তি চাকুরির বাজার সংকুচিত করিবে, সম্ভাব্যভাবে অনেক লোককে বেকার করিবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের গোপনীয়তা, পক্ষপাত এবং ন্যায্যতার মতো ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করিতে পারে। সবচাইতে বিপজ্জনক হইল—ইহা স্বায়ত্তশাসিত অস্ত্রের ক্ষেত্রে তথা মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই জীবন-মৃত্যুর সিদ্ধান্ত লইতে পারে।

সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতাদের প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন চ্যাটজিপিটির প্রধান সংস্থা ওপেনএআইয়ের সিইও স্যাম অল্টম্যান। গত মঙ্গলবার মার্কিন সিনেট কমিটির সামনে নূতন প্রযুক্তির সম্ভাবনা এবং ইহার ত্রুটিগুলি সম্পর্কে সাক্ষ্য দিয়াছেন। চ্যাটজিপিটি এবং অন্যান্য অনুরূপ প্রোগ্রামগুলি অবিশ্বাস্যভাবে মানুষের মতোই বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর তৈরি করিতে পারে বটে, তবে ইহা অনেক ভুল তথ্যও দিতে পারে। অবশ্য ইহা নিজে নিজেই শিখিয়া লয়, ফলে নিজেকে সংশোধন করিতে পারে দ্রুত। অল্টম্যান মার্কিন আইনপ্রণেতাদের বলিয়াছেন যে, তিনি গণতন্ত্রের উপর ইহার সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। নির্বাচনের সময় কোনো নির্দিষ্ট স্থানে ভুল তথ্য পাঠাইতে এআই কীভাবে ব্যবহার হইতে পারে, সেই কথাও তিনি তুলিয়া ধরিয়াছেন। তাৎপর্যপূর্ণভাবে একজন সিনেটর বলিয়াছেন যে, ইহা একধরনের বৈপ্লবিক প্রযুক্তি হইতে পারে, তবে নূতন প্রযুক্তিকে ‘পারমাণবিক বোমা’ আবিষ্কারের সহিত তুলনা করিয়াছেন তিনি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ‘পারমাণবিক বোমা’ কিংবা ‘পারমাণবিক শক্তি’—যাহার মতোই হউক না কেন—উহা এখন এই বিশ্বকে বৈপ্লবিক এক পরিবর্তনের বাঁকে দাঁড় করাইয়াছে—ইহাই চরম বাস্তবতা।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন