বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৩ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

ফরিদপুরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন

হুমকিতে পদ্মার তীর সংরক্ষণ বাঁধ

আপডেট : ২০ মে ২০২৩, ০৩:৩০

ফরিদপুরে প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তুলে বিক্রি করা হচ্ছে। এলাকাবাসী জানিয়েছে, বালু ব্যবসার কারণে হুমকিতে রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পদ্মার তীর সংরক্ষণ বাঁধ। বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে ফরিদপুর শহর। বালুঝড় ও মেশিনের শব্দে অতিষ্ঠ সেখানকার জনজীবন।

মূলত বেসরকারি উদ্যোগে একটি স্টেডিয়াম নির্মাণ করার কথা বলে এ বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। অবৈধ এ ব্যবসা পরিচালনা করতে ব্যবহার করা হচ্ছে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শামীম হকের নাম। দিনের পর দিন এই ঘটনা ঘটলেও বিষয়টি না দেখার ভান করা হচ্ছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। পাঁচ-ছয় মাস ধরে কাদেরের বাজারসংলগ্ন পদ্মা নদীর আধা কিলোমিটার ভেতর থেকে রাতের আঁধারে খননযন্ত্র (ড্রেজার) দিয়ে বালু কাটা হচ্ছে।

ফরিদপুর সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিটন ঢালীও স্বীকার করে বলেন, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলা হচ্ছে। এ ব্যাপারে কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। একটি স্টেডিয়াম নির্মাণের কথা বলা হলেও বালু তুলে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হক বলেন, শেখ কামালের নামে একটি স্টেডিয়াম নির্মাণের জন্য ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিয়েছি। বায়তুল আমান এলাকায় টিচার্স ট্রেনিং কলেজের পাশে আড়াই একর জমি ইজারা নেওয়া হয়েছে। সেখানে একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম করা হবে। ঐ জায়গা ভরাট করার জন্য বালু তোলা হচ্ছে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকের মৌখিক সম্মতি আছে। কোনো বালু বিক্রি করা হচ্ছে না দাবি করে শামীম হক বলেন, যদি এমন কোনো কাজ আমাকে ব্যবহার করে কেউ করে থাকে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ফরিদপুর শহরতলির আলীয়াবাদ ইউনিয়নের ভাজনডাঙ্গা, গদাধরডাঙ্গী ও কাদেরের বাজার এলাকার গোয়ালন্দ-তাড়াইল সড়কের পূর্ব পাশে অন্তত পাঁচটি জায়গায় স্তূপ করে রাখা হয়েছে নদী থেকে তোলা বালু। সেখান থেকে প্রতিদিন বালু বিক্রি করা হচ্ছে। ট্রাকে করে বালু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শহরের বিভিন্ন জায়গায়।

ফরিদপুর শহরের টেপাখোলা হয়ে তাড়াইল সড়ক ধরে দুই কিলোমিটার আগালেই পদ্মার সংযোগ খাল মান্দারতলা। মান্দারতলা খালের উত্তর পাশে ভাজনডাঙ্গা মামা-ভাগনে এন্টারপ্রাইজ বালু বিক্রির সঙ্গে জড়িত। এ প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. এমদাদুল হক। মক্কা এন্টারপ্রাইজের মো. মুক্তার হোসেন ও মদিনা এন্টারপ্রাইজের মো. টিটু তাদের পার্টনার। ঐ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রাস্তা সংলগ্ন প্রায় ২ একর জমি জুড়ে রয়েছে তাদের বালুর চাতাল।

মামা-ভাগনে এন্টারপ্রাইজের পার্টনার মো. টিটু বলেন, দুই বছর আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে পদ্মায় ড্রেজিং করা হয়। তারা সেই বালু কিনে এখানে রেখে ব্যবসা করেন। ঐ বালু শেষ হওয়ার পর আলিয়াবাদের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে বালু কিনে এনে তারা বিক্রি করছেন। টিটু বলেন, সাইনবোর্ড এলাকায় শেখ কামাল স্টেডিয়ামের জন্য নদী থেকে ড্রেজিং করে বালু তুলে স্তূপ করে রাখা হয় পাড়ে। সেখানে সাগর, হেলাল ও তুহিন দায়িত্বে আছেন। তাদের মাধ্যমে বালু কিনে আনেন।

মামা-ভাগনে চাতালের ১০০ গজ আগেই হিরুর চাতাল। চাতালের পাশের বাড়ির অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য মুন্নু ভূঁইয়ার বলেন, বালু ব্যবসায়ীদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। রাতে যখন মেশিন চালায় ঘুমাতে পারি না। তাদের সব জায়গাজমি অবৈধ বালু ব্যবসার কারণে পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। বালুর পানি চুইয়ে নদীতে পড়ায় নদীর তীর সংরক্ষণ কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চাতালের পাশের বাড়ির জাহিদ মতুব্বরের স্ত্রী রোজী আক্তার বলেন, ‘চলাচলের রাস্তা নেই। বালু যখন চাতালে ড্রেজার দিয়ে নামায়, তখন বিকট শব্দে ঘুমাতে পারি না। স্তূপ করা বালুর পানিতে উঠানে বন্যা হয়ে যায়। বাঁধসংলগ্ন চাতালের পানি গড়িয়ে আবার পদ্মায় নামে। পানি নামতে নামতে পদ্মার পাড় ভেঙে যাচ্ছে। কখন যে আমাদের বাড়ি ভেঙে পদ্মায় চলে যায়।’

ফরিদপুর-চরভদ্রাসন সড়ক দিয়ে দক্ষিণে একটু এগোতেই কাদেরের বাজারসংলগ্ন মজিবর বিশ্বাসের বালুর চাতাল। তাদের ব্যবসায়িক অংশীদার সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক রফিকুল ইসলাম। চাতালের সেখানকার মো. জাহাঙ্গীর নামে এক ব্যক্তি বলেন, এটা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামিম হকের চাতাল।

সেখান থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে পদ্মাসংলগ্ন সাইনবোর্ড এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ১৫ একর জায়গা জুড়ে উঁচু স্তূপ করে বালু রাখা হয়েছে। শেখ কামাল স্টেডিয়ামের জন্য বালু রাখা চাতালে গিয়ে দেখা যায়, দুটি ড্রেজার বসানো রয়েছে নদীতে। শ্রমিক সজীব মিয়া জানান, ড্রেজারটির মালিক চরভদ্রাসন উপজেলার দিপু খান। রাতে তারা মেশিন চালান।

এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নদী থেকে বালু তোলা ও বিক্রি করার পেছনে রয়েছেন চার জন। তারা হলেন—ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাদীপুর এলাকার শেখ সাদী, সহসভাপতি বিলমাহমুদপুর মুন্সীরডাঙ্গী এলাকার তোফাজ্জেল হোসেন সম্রাট, সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক গদাধরডাঙ্গী এলাকার মো. রফিকুল ইসলাম ও গদাধরডাঙ্গী এলাকার মজিবর বিশ্বাস।

তবে শেখ সাদী বলেন, ‘আমি এর সঙ্গে জড়িত নই। বালু বহু আগে থেকেই কাটা হচ্ছে। আগে আখতারুজ্জামান বিশ্বাসের নেতৃত্বে কাটা হতো, এখন যারা কাটছেন, তারা তার সঙ্গে ছিলেন। এটি একটি আবাসিক এলাকা। এ এলাকায় বালু তোলা ও বিক্রির ব্যবসা হতে পারে না।

আকতারুজ্জামান বিশ্বাস বলেন, আমি বালুর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নই। দুই বছর আগে নদীখনন করেছিল বিআইডব্লিউটিসি। ঐ সময় আমি নদী থেকে তোলা বালু রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। সেই বালু পরে সরকার নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করেছে।

ইত্তেফাক/এমএএম