বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

অভিবাসন জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত

আপডেট : ২০ মে ২০২৩, ০৭:০০

বর্তমান বিশ্বে অভিবাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু। অভিবাসন সাধারণত দুই রাষ্ট্রের ভেতরে হয়ে থাকে। আর সে কারণেই সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র দুটি দ্বিপাক্ষিক সব বিষয় দেখাশোনা (ডিল) করে। এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে যখন অভিবাসনের বিষয়াবলি নিয়ে ডিল হয়, তখন যারা গ্রহীতা দেশ তারা অনেক কিছুই প্রেরণকারী দেশের ওপর চাপিয়ে দেয়। বিশেষ করে, গ্রহীতা দেশ সব সময়ই চেষ্টা করে কীভাবে বেশি লাভবান হওয়া যায়। এ কারণে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই শ্রমিকের অধিকার ক্ষুণ্ন হয় বা যে অধিকার তাদের প্রাপ্য তা দেওয়া হয় না। বিশেষ করে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের তুলনামূলক কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। অভিবাসী শ্রমিকরা যেহেতু অসহায়, তাই তারা বাধ্য হয়ে তুলনামূলক কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হয়। বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য গিয়ে শ্রমিকদের নানাভাবে বঞ্চনা ও হয়রানির শিকার হতে হয়। যেসব শর্ত মেনে অভিবাসন হওয়ার কথা তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পূরণ হয় না। অনেকেই ব্যর্থ অভিবাসী হয়ে দেশে ফেরত আসেন। অনেকেই শারীরিক এবং মানসিকভাবে লাঞ্ছিত হন। ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অধিকাংশই কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ পান না। আবার এটাও ঠিক যে, অনেকেই ভালো কাজ করে সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ অর্থোপার্জন করে দেশে প্রেরণ করছেন। জাতিসংঘ মনে করে, সবচেয়ে ভঙ্গুর (ভারনারেবল) শ্রমশক্তি হচ্ছেন অভিবাসী শ্রমিকেরা। এই অবস্থায় জাতিসংঘ ২০০৪ সালে একটি গ্লোবাল কমিশন অন মাইগ্রেশন তৈরি করে। গ্লোবাল কমিশন অন মাইগ্রেশন যে রিপোর্ট প্রণয়ন করে, তার ভিত্তিতে তৈরি হলো গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন ডেভেলপমেন্ট। গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, এটা একটি ফোরাম মাত্র। গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন ২০০৬ সাল থেকে অনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে। বলা হলো, জাতিসংঘের যত আন্তঃসংস্থা আছে তারা সবাই মিলে এখানে অংশ গ্রহণ করবে। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত এটা একটি নন-বাইন্ডিং বডি হিসেবে কাজ করছে (জিএফএমডি)। এই ফোরামের সম্মেলন একবার হোস্ট করে অভিবাসী প্রেরণকারী দেশ। পরের বার হোস্ট করে অভিবাসী গ্রহণকারী দেশ। জিএফএমডিতে সরকারি পর্যায়ে আলোচনা হয়। আবার সিভিল সোসাইটি লেভেলেও দাবিগুলো উঠে আসে, যা সরকারি পর্যায়ে পৌঁছে যায়। গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট গঠিত হওয়ার পর থেকে কতগুলো বিষয় বারবার গুরুত্ব পাচ্ছে। এগুলো হচ্ছে অভিবাসনের উচ্চ ব্যয়। আমরা প্রত্যক্ষ করছি, অভিবাসনের জন্য স্বাভাবিকভাবে যে অর্থ ব্যয় হওয়ার কথা, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ নেওয়া হচ্ছে। আমরা যদি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি আলোচনা করি, তাহলে দেখব, মালয়েশিয়ার জনশক্তি প্রেরণের জন্য যে ব্যয় নির্ধারণ করে দেওয়া আছে তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করে একজন অভিবাসনপ্রত্যাশীকে মালয়েশিয়ায় যেতে হচ্ছে। একজন অভিবাসনপ্রত্যাশীকে মালয়েশিয়া গমন করার জন্য ৪-৫ লাখ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে অনেক দিন ধরেই। তারা চেষ্টা করছে কীভাবে অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনা যায়। দ্বিতীয়ত, অবৈধ পথে অভিবাসন নিয়ে ফোরামে আলোচনা হচ্ছে। অবৈধভাবে যারা অভিবাসন করছে সেই মানুষগুলোকে অবৈধ মানুষ বলা হচ্ছে। তাদের অভিবাসন প্রক্রিয়াটা বৈধ নয়। তাই বলে মানুষকে তো আর অবৈধ বলা যায় না। বিষয়টি নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। আলোচনায় অভিবাসন গ্রহণকারী দেশগুলো এই বিষয়টি প্রতিটি মিটিংয়েই তুলে ধরে। তারা বলছে, তাদের দেশে গিয়ে কীভাবে মানুষ অবৈধ হয়ে যাচ্ছে। এসব অবৈধ অভিবাসীদের কারণে তাদের দেশের অর্থনীতি এবং সামাজিক ব্যবস্থায় কী কী সমস্যা হচ্ছে, এটা তারা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে। অভিবাসী প্রেরণকারী দেশগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিদেশে অভিবাসন করার পর মানুষগুলো অবৈধ হয়ে যাচ্ছে, তার কারণ হলো, যে শর্তে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় তা প্রায়শই লঙ্ঘন করা হয়। তাদের তুলনামূলক কম মজুরি দেওয়া হয়। ফলে অভিবাসনকারী মানুষগুলো এক পর্যায়ে কর্মক্ষেত্র বদল করতে বাধ্য হয়। এতে তারা অবৈধ হয়ে যাচ্ছে। নারী অভিবাসীদের বিষয়টি প্রতিটি জিএফএমডিতেই আলোচিত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারী অভিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তারা বিদেশে গিয়ে তাদের উপযুক্ত সম্মান ও অধিকার পাচ্ছেন না। যারা বিদেশে যান তাদের অধিকাংশই গৃহকর্মী হিসেবে গমন করেন। তারা গৃহকর্মী, দাস নন। কাজেই একজন গৃহকর্মীর উপযুক্ত মজুরি ও সম্মান নিশ্চিত করা জরুরি। ফোরাম বিভিন্ন সময় নারী অভিবাসীদের ওপর দমন-পীড়ন এবং অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধ করার জন্য দাবি জানিয়ে আসছে। গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে এসব বিষয় আলোচিত হওয়ার ফলে সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইন, ওমান, ইউএই ইত্যাদি দেশে অনেক সংস্কার সাধন করা হয়েছে নারী অধিকার সম্পর্কে। অভিবাসী ব্যক্তির পাসপোর্ট নিজের কাছে রাখার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এটাও হয়েছে গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে আলোচনার কারণেই। অভিবাসনের সামাজিক মূল্যের বিষয়ে নিয়েও আলোচনা হয়েছে। একজন অভিবাসী দেশে ফিরে আসার পর আর কোথাও যেতে পারছে না এ বিষয়টিও আলোচনা হচ্ছে। কোভিডের পর মূল আলোচনা হয়েছে ইন্টিগ্রেশনের বিষয়ে। কোভিডের কারণে যারা বিদেশ থেকে ফিরে আসছেন, তাদের নিজ সমাজে, পরিবারে কীভাবে মানসিকভাবে পুনরেকত্রীকরণ করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানও পুনরেকত্রীকরণ নিয়ে কাজ করছে। সোনার মানুষ সম্মাননা দিচ্ছে। 

গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এবারের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে ফ্রান্সে। আসন্ন সম্মেলনের একটি অন্যতম প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিবাসন।’ নানা কারণে মানুষ বিদেশে যায়। সাধারণত মানুষ বিদেশে যায় তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তন মানুষের আগের সংকটগুলোকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষ তার আবাসন হারিয়ে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভূমিহীন হয়ে পড়ছে। অনেক এলাকায় নদীভাঙন দেখা দেয়। নদীভাঙন এলাকার মানুষ বাড়িঘর হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। তারা বাধ্য হয়ে বাস্তুচ্যুতির কারণে কাজের আশায় বিভিন্ন শহরে-উপশহরে চলে আসছে। অর্থাত্ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যবহার করছেন মাইগ্রেশনকে। জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত বিভিন্ন ফোরামে মাইগ্রেশন তেমন একটা আলোচিত হয়নি। কপ-২৭ সম্মেলনে এসে কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভিবাসন হচ্ছে। অর্থাত্ অভিবাসনের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের একটি কমিশন তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২১৬ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে, যদি উপযুক্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়। প্রতিবেদনে বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ছয়টি হট স্পট বিবেচনা করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, শুধু দক্ষিণ এশিয়াতে ৪০ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় যে ৪০ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে তার মধ্যে শুধু বাংলাদেশেই বাস্তুচ্যুত হবে ১৯ মিলিয়ন মানুষ। অর্থাত্ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাস্তুচ্যুতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। উপযুক্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে ৮০ শতাংশ বাস্তুচ্যুতি ঠেকানো সম্ভব হতে পারে। আর বাস্তুচ্যুতি ঠেকানো গেলে অভিবাসনও কমানো সম্ভব হবে। অভিজ্ঞজনরা বলছেন, এখন প্রত্যেকটি আন্তর্জাতিক ফোরামের অভিবাসনকে আলোচনায় নিয়ে আসতে হবে। প্রথম বারের মতো অভ্যন্তরীণ অভিবাসন একটি বড় ইস্যু হিসেবে চলে আসছে। কারণ যারা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগই গ্রাম থেকে শহরে আসা অথবা এক শহর থেকে আর এক শহরে চলে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশ সরকার বাস্তুচ্যুতির ওপর একটি জাতীয় কৌশলপত্র তৈরি করেছে। এটি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভ্যন্তরীণ অভিবাসন ব্যবস্থাপনা একই সঙ্গে একটি অ্যাকশন প্ল্যানও তৈরি করা হয়েছে। এটা তৈরি করেছে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয় এখন অ্যাকশন প্ল্যানটা বাস্তবায়ন করতে চাইছে। এই অ্যাকশন প্ল্যানটি হচ্ছে ২০ বছর মেয়াদি। এখন থেকে আগামী ২০ বছরের মধ্যে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্যে একটি বড় বিষয় হচ্ছে, যারা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন বা বাস্তুচ্যুত হতে পারেন, তাদের অভিযোজন এবং পুনর্বাসন করা। বাংলাদেশ সরকারের এখন প্রধান দায়িত্ব হবে গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সম্মেলনে এই প্ল্যানটিকে উপস্থাপন করা। অভিবাসন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এখন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্ল্যানটি বুঝে নিয়ে গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সম্মেলনে উপস্থাপন করা।

লেখক: চেয়ারপারসন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন, রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিচার্স ইউনিট

অনুলিখন: এম এ খালেক

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন