ফৌজদারি মামলায় যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণা না করে আসামির সাজা নির্ধারণে পৃথক শুনানি করতে নির্দেশনা দিয়েছিল হাইকোর্ট। উচ্চ আদালতের এই নির্দেশনা অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের এখনই প্রতিপালন করতে হচ্ছে না। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম সোমবার হাইকোর্টের এই নির্দেশনা স্থগিতের আদেশ দিয়েছেন।
আগামী ১৫ জুলাই পর্যন্ত এই স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছে। ওইদিন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে এই স্থগিতাদেশের বিষয়ে পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রের শীর্ষ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এএম আমিন উদ্দিন।
ফৌজদারি মামলায় যুক্তিতর্ক শেষে দোষী সাব্যস্তের পরই আসামিকে শাস্তি দিয়ে থাকেন অধস্তন আদালতের বিচারক। কিন্তু নতুন এই প্রক্রিয়ায় যুক্তিতর্কের পর রায় না দিয়ে আসামির সাজা নির্ধারণে পৃথক শুনানির করতে নির্দেশনা দেয় হাইকোর্ট। সেই নির্দেশনায় বলা হয়, যখন মামলায় উভয় পক্ষের চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয় তখন বিচারক আসামিকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা কয়েক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। তখন বিচারক তার মনের এই কথাটি উন্মুক্ত আদালতে মামলার উভয় পক্ষের আইনজীবীদের জানাবেন। এরপর আসামির উপযুক্ত শাস্তি নির্ধারণের বিষয়ে পৃথক শুনানির জন্য স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একটি তারিখ ধার্য করবেন। সেই ধার্য তারিখের শুনানিতে অপরাধীর বয়স, চরিত্র, ব্যক্তি বা সমাজের প্রতি সংঘটিত অপরাধের প্রভাব, অপরাধী অভ্যাসগত, সাধারণ নাকি পেশাদার প্রকৃতির, অপরাধীর উপর শাস্তির প্রভাব, বিচার বিলম্ব এবং দীর্ঘস্থায়ী বিচার চলায় কারাগারে আটক থাকায় অপরাধীর মানসিক যন্ত্রণার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে বিচারককে। যাতে একজন অপরাধী নিজেকে সংশোধন ও সংস্কারের সুযোগ পান। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে আসামির শাস্তির বিষয়ে রায় দেবেন বিচারক।
হাইকোর্টের এই নির্দেশনা প্রতিপালনে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নির্দেশ দিয়ে এ বিষয়ে সার্কুলার জারি করতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দেওয়া হয় রায়ে। এরপর এই নির্দেশনা স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করেন রাষ্ট্রপক্ষ।
আবেদনের শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এএম আমিন উদ্দিন বলেন, হাইকোর্ট সাজা নির্ধারণে পৃথক শুনানির যে নির্দেশনা বিচারকদের দিয়েছেন সেটা ফৌজদারি কার্যবিধিতে (সিআরপিসি) নাই। এই নির্দেশনা প্রতিপালন করা এখন আইনগতভাবে কতটুকু সম্ভব সেটার বিবেচনার দাবি রাখে। তাই আমরা মনে করি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। সেই পর্যন্ত এই নির্দেশনা স্থগিতের আবেদন করছি। শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি হাইকোর্টের নির্দেশনা ১৫ জুলাই পর্যন্ত স্থগিতের আদেশ দেন।
প্রসঙ্গত, তিন বছর আগে ‘আতাউর মৃধা বনাম রাষ্ট্র’ মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলেছিল, বাংলাদেশের বিচারকদের জন্য শাস্তি প্রদানের কোন গাইডলাইন নাই। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই এই শাস্তি প্রদানের নীতিমালা আছে। তাই শাস্তি প্রদানের জন্য বাংলাদেশে আইনসিদ্ধ নির্দেশিকা প্রয়োজন। অপরাধের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে এই নির্দেশিকা প্রণয়ন জরুরি। অতীতের ন্যায় সেনটেন্সিং হিয়ারিং (দন্ড শুনানি) বিচারব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনা উচিত। সেক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারী ও আবেগনির্ভর শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
এই রায়ের পর এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট দণ্ড প্রদান নীতিমালা প্রণয়ন প্রশ্নে রুল জারি করে। ওই রুলে বিচারব্যবস্থায় দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে সমতার প্রশ্নে নীতিমালা প্রণয়নে কেন সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হবে তা জানতে চাওয়া হয়। বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম (বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতি) ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ ২০২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর এই আদেশ দেন।
আদালত বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই দণ্ড প্রদান নীতিমালা (সেনটেন্সিং গাইডলাইন) রয়েছে। আমাদের দেশে এটা নিয়ে এখন ভাবার সময় এসেছে।
ওই রুল হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। এরপর গত মার্চ মাসে ‘রাষ্ট্র বনাম মো. লাভলু’ মামলায় বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি বিশ্বজিৎ দেবনাথের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে সাজা নির্ধারণের পৃথক শুনানি করতে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নির্দেশনা দেন।