আজ ২৪ মে বিশ্ব সিজোফ্রেনিয়া দিবস। এই দিবসের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, এই রোগ সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করে তোলা এবং এ নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা ও কুসংস্কার দূর করা। এবারের প্রতিপাদ্য ‘সামাজিক সহানুভূতির শক্তিকে উজ্জীবিত করি’। সিজোফ্রেনিয়া একটি সাইকোটিক জাতীয় মারাত্মক মানসিক রোগ, যার কারণে ব্যক্তি বাস্তবতাকে অস্বাভাবিকভাবে ব্যাখ্যা করে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির চিন্তা, আবেগ, অনুভূতি, পারস্পরিক সম্পর্ক ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। এই রোগীদের বেশির ভাগের ইনসাইট খুব দুর্বল হয়, সে কারণে তারা নিজে নিজে চিকিৎসা নিতে চায় না। মানসিক রোগের সবচেয়ে গুরুতর ও সবচেয়ে অক্ষম করে তোলা রোগের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া অন্যতম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, রোগজনিত অক্ষমতার প্রথম ১০টি কারণের একটি সিজোফ্রেনিয়া। বাংলাদেশ সরকারের সর্বশেষ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে (২০১৮-২০১৯) দেখা যায় যে, জনসংখ্যার প্রতি ১০০ জনের এক জন এই রোগে আক্রান্ত। সাধারণত ১০ থেকে ২৫ বছরের ছেলেরা এবং ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সি মেয়েরা প্রথম এই রোগে বেশি আক্রান্ত হন। বর্তমান বিশ্বে এই রোগীদের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ—যাদের ৯০ ভাগের বেশি আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বসবাস করেন।
সিজোফ্রেনিয়া কী?
ডিএসএম-৫ অনুযায়ী নিচের (১) বা (২) বা (৩)-সহ কমপক্ষে দুটি লক্ষণ এক মাসের বেশি থাকলে সে সমস্যাকে সিজোফ্রেনিয়া বলে। (১) ভ্রান্তবিশ্বাস : রোগীদের মধ্যে এমন ধরনের বিশ্বাস সৃষ্টি হয়, যার কোনো প্রমাণ নেই। কোনো যুক্তি এই বিশ্বাসকে সমর্থন করে না। যেমন—রোগী উপযুক্ত কারণ ছাড়াই, তিনি মনে করেন তার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, এমনকি ছেলের বউ তাকে পাগল বানানোর চেষ্টা করছে কিংবা তার খাবারে বিষ দিয়ে তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। (২) অমূলক প্রত্যক্ষণ : ব্যক্তি এমন কিছু অবাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান, যাতে তিনি তার চোখ, কান, জিহ্বা বা ত্বক এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের কোনোটি দিয়ে কোনো বাস্তব অনুভূতি না পাওয়া সত্ত্বেও তার মনে হয় তিনি এগুলোর সাহায্যে বাস্তব অনুভূতি পাচ্ছেন। যেমন :ব্যক্তি কোনো শব্দ, কথা বা গান শুনতে পায়, যা অন্যরা শুনতে পায় না। (৩) অসংলগ্ন কথাবার্তা :এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কথাবার্তা অসংলগ্ন হয়। তারা ক্রমাগত বিচ্ছিন্নভাবে কথা বলেন, অর্থাৎ কথার শুরু আর শেষের মধ্যে অসংগতি দেখা যায়।
(৪) অস্বাভাবিক আচরণ :তারা কখনো একেবারে চুপচাপ থাকেন, আবার কখনো তারা অতিরিক্ত নড়াচড়া করেন। অনেক সময় তাদের ভাবভঙ্গি অদ্ভুত ধরনের হয়। (৫) নেতিবাচক উপসর্গ :অনেক সময় তাদের মুখে কোনোভাবের প্রকাশ থাকে না। তারা কথা বলার সময় হাত বা মাথা নেড়ে ভাবের প্রকাশ করে না। তাদের প্রশ্ন জিগ্যেস করলে অল্প কথায় উত্তর দেয় বা বেশি কথা বলে কিংবা চুপচাপ থাকে। অনেক সময় তাদের পোশাকসহ নিজেদের যত্ন নিতে পারেন না। অনেক সময় তাদের কাজের আগ্রহ থাকে না।
সিজোফ্রেনিয়ার কারণ :অনেক কারণেই সিজোফ্রেনিয়া হতে পারে। সংক্ষেপে কিছু কারণ দেওয়া হলো—বংশে কারো থাকলে এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। মা-বাবা দুই জনের এই রোগ হলে সন্তানের ৪৬ শতাংশ, আর এক জনের হলে ১৭ শতাংশ আশঙ্কা থাকে। মস্তিষ্কে রাসায়নিক উপাদানের ত্রুটির ফলে নিউরোক্যামিক্যাল উপাদানের ভারসাম্যহীনতা এই রোগের জন্য দায়ী। জন্মকালীন জটিলতা, গর্ভকালীন সময়ে মায়ের রুবেলা ভাইরাস বা ইনফ্লুয়েঞ্জা হলে এ রোগের আশঙ্কা থাকতে পারে। অন্য দেশে বসবাস, সমাজে বঞ্চিত থাকা, অবিবাহিত, একাকী বা কম বন্ধু থাকলে এই রোগের আশঙ্কা বেশি থাকে। জীবনের দুঃখজনক কোনো ঘটনা ঘটলে এই রোগের আশঙ্কা বেড়ে যায়।
চিকিৎসা :সিজোফ্রেনিয়া রোগটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল হলেও বর্তমানে কার্যকরী চিকিৎসা আছে। এই রোগের প্রধান চিকিৎসায় বর্তমানে বেশকিছু আধুনিক মেডিসিন আছে, যেগুলো সিজোফ্রেনিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের মতো এই রোগে সারা জীবন চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়। তবে রোগের মাত্রা বেশি হলে এই রোগীদের ইনসাইট (নিজের একটা রোগ হয়েছে এটা বোঝার ক্ষমতা) থাকে না। তাই তারা মেডিসিন খেতে চায় না। এরকম পরিস্থিতিতে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হয়। বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি অনেক হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা আছে।
গবেষণায় দেখা যায় যে, সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা ২৫ শতাংশ রোগী চিকিৎসার পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়। আর ৫০ শতাংশ রোগী মেডিসিন ব্যবহার করে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন। বর্তমানে গবেষণায় দেখা যায় যে, যারা মেডিসিনের পাশাপাশি কগনিটিভ বিহেবিয়ার থেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করেন তাদের ভালো হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। এসব রোগীর সিস্টেমেটিক ফ্যামিলি থেরাপি ব্যবহার করে পারিবারিক সমস্যাগুলো কমানো হয়। মাইন্ডফুলনেন্স প্র্যাকটিস করিয়ে বর্তমানে থাকার অভ্যাস করার মাধ্যমে তাদের অভিযোজন ক্ষমতা বাড়ানো হয় এবং চাপ ম্যানেজমেন্ট শেখানো হয়। ইমোশনাল রেগুলেশন থেরাপি ব্যবহার করে রোগীর নেতিবাচক আবেগগুলো কমানো এবং ইতিবাচক আবেগ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসায় সিজোফ্রেনিয়া রোগীরা ভালো হন এবং সারা জীবন সুস্থ থাকতে পারেন। তাই রোগীদের দূরে ঠেলে না দিয়ে এবং ভ্রান্ত ধারণা বাদ দিয়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
লেখক : ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট