সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের হাজানো গ্রামের বাসিন্দা ইব্রাহিম ওথমানের। বয়স ৫৯ বছর। গ্রামটি বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত। একদিন ফজরের নামাজ আদায় করতে একাই মসজিদে গিয়েছিলেন ইব্রাহিম। কিন্তু নামাজ শেষে সঙ্গে এনেছিলেন সদ্য জন্ম নেওয়া এক মেয়ে শিশুকে।
বাড়িতে ফিরে ইব্রাহিম তার স্ত্রীকে জানান, তীব্র শীতের মধ্যে মসজিদের সামনে এই নবজাতককে কেউ ফেলে গেছে। তাই তিনি সেখান থেকে শিশুটিকে কুড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। ইব্রাহিম তার স্ত্রীকে বলেন, ‘আমি তোমার জন্য উপহার হিসেবে শিশুটিকে এনেছি।’
ইব্রাহিম দম্পতি শিশুটির নাম রাখেন হিবাতুল্লাহ। যার অর্থ ‘ঈশ্বরের উপহার’। পরিবারের সদস্য হিসেবে শিশুটিকে বড় করার সিদ্ধান্ত নেন এই মা–বাবা।
শুধু হাজানো গ্রামের এই শিশু নয়, এমন অনেক নবজাতকের দেখা পাওয়া যায় সিরিয়ার মসজিদের সামনে, হাসপাতাল এমনকি জলপাইবাগানে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে এসব নবজাতকের ঠাঁই হয় না পরিবারে। তাই ফেলে দেওয়া হয় তাদের।
কর্মকর্তারা বলছেন, ১২ বছরের বেশি সময় ধরে চলমান যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় সিরিয়ার মানুষ আরও দরিদ্র হয়েছে। অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের লালনপালন করতে পারে না। তাই ছোট অবস্থায়ই মসজিদ কিংবা হাসপাতালের সামনে ফেলে যায়।
সিরিয়ায় সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো নিয়মিত নথিবদ্ধ করে রাখে ওয়াশিংটনভিত্তিক সংগঠন সিরিয়ানস ফর ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস। সংগঠনটি বলছে, ২০১১ সালে যুদ্ধ শুরুর আগে সিরিয়ায় এভাবে নবজাতককে ফেলে যাওয়ার কয়েকটি ঘটনা নথিবদ্ধ করা হয়েছিল। এখন এই সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
সংগঠনটি বলছে, যুদ্ধ শুরুর পর এই সংখ্যা ‘নাটকীয়ভাবে’ বেড়ে গেছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত ও বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত—উভয় অঞ্চলে এসব ঘটনা ঘটছে। এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধ–কবলিত সিরিয়ার আর্থ–সামাজিক পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে।
যুদ্ধের কারণে সিরিয়ায় একদিকে অস্থিতিশীলতা ও মানুষের নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে, অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দারিদ্র, বাল্যবিবাহ, যৌন হয়রানি এবং বিয়ের ছাড়াই গর্ভধারণের ঘটনা। এসব কারণে অনেকেই নবজাতককে নিজের সঙ্গে রাখতে পারেন না।
যদিও সিরিয়ায় শিশু দত্তক নেওয়া নিষিদ্ধ। এ কারণে শিশু হিবাতুল্লাহকে নিজের পরিবারের সঙ্গে রেখে বড় করার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি চেয়েছেন ইব্রাহিম।
এ বিষয়ে ইব্রাহিম বলেন, ‘আইনত হিবাতুল্লাহ আমার পরিবারের অংশ হতে পারবে না। আমি আমার অন্য সন্তানদের বলেছি, আমার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার হিসেবে হিবাতুল্লাহর একটা অংশ থাকা উচিত।’
হিবাতুল্লাহর বয়স এখন তিন বছর। ইব্রাহিমকে শিশুটি ‘দাদা’ বলে ডাকে। ইব্রাহিম বলেন, সে নিষ্পাপ একটি শিশু।
এক দশকের বেশি সময় ধরে চলমান সিরিয়া যুদ্ধে এখন পর্যন্ত পাঁচ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ধ্বংস হয়ে গেছে দেশটির অসংখ্য অবকাঠামো।
সিরিয়ার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা জাহের হাজ্জো বলেন, গত বছরের প্রথম ১০ মাসে দেশটির সরকার–নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোয় ৫৩ নবজাতকে ফেলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৮টি ছেলেশিশু ও ২৫টি মেয়েশিশু।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ চলতি বছর একটি ডিক্রি জারি করেছেন। এতে বলা হয়েছে, ফেলে যাওয়া এসব শিশু আরব, মুসলিম ও সিরীয় হিসেবে পরিচিত হবে। এই পরিচয়ে তাদের সরকারিভাবে নথিবদ্ধ করতে হবে। যে এলাকায় এসব শিশুকে পাওয়া যাবে, সে এলাকাকে শিশুর জন্মস্থান হিসেবে নথিবদ্ধ করতে হবে।
বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ইদলিব প্রদেশের পরিত্যক্ত একটি শিশুকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, এক সমাজকর্মী একটি ছোট্ট শিশুকে দোলনায় দোল খাওয়াচ্ছেন। একটি কম্বলে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে শিশুটিকে। পাশেই আরেকটি শিশুকে দুধ খাওয়ানো হচ্ছে।
ওই কেন্দ্রের হেড অব প্রোগ্রাম ফয়সাল আল–হামৌদ বলেন, ছোট্ট একটি মেয়েশিশুকে জলপাইগাছের নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে তারা শিশুটিকে কুড়িয়ে এনেছেন। শিশুটিকে বিড়াল আঘাত করেছিল। মুখ দিয়ে রক্ত ঝড়ছিল। পরে শিশুটিকে লালনপালনের জন্য একটি পরিবারের কাছে দেওয়া হয়।